প্রথম মেডিকেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অ্যালামনাই
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
দেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৮ সালে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক প্রচেষ্টায় তৎকালীন আইপিজিএমএন্ডআর একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। শুরুর পর থেকে পেরিয়ে গেছে অনেকটা সময়। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিশ্ববিদ্যালয় শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে উত্তীর্ণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ যে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, তা ২০২১ সাল পর্যন্ত ছিলো অনুপস্থিত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক প্রচেষ্টা হয়েছে এই ২৩ বছর। কিন্তু জোরালো কোনো প্রচেষ্টা যে হয়নি তার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো শুরু হবার প্রথম ২৩ বছরেও অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন না হওয়া। আমি দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং বাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা শুরু করি। এরই ফলশ্রুতিতে র্যাংকিং প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রয়োজনীয়তার অনুভব করি।
অ্যালামনাই (অষঁসহর) যার বাংলা দাঁড়ায় প্রাক্তন, বলতে বোঝায় যাঁরা কোনো স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে জ্ঞানার্জন করে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং নিজের দায়িত্ববোধ থেকে অর্জিত জ্ঞান সমাজ বিনির্মানের মাধ্যমে দেশের উন্নতি সাধনের জন্য ব্যবহার করছে। ‘এসোসিয়েশন’ (অংংড়পরধঃরড়হ) অর্থাৎ সংঘ বা সংগঠন হলো কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্য নিয়ে কিছু সংঘবদ্ধ মানুষের আইন-কানুন মেনে একত্রিত হওয়া। অ্যালামনাই এসোসিয়েশন হলো কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন, যা প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি কমন প্লাটফর্ম তৈরি করে, ভাতৃত্ব এবং একতা সুদৃঢ় করে, প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের দায়িত্ববোধ থেকে প্রতিষ্ঠানের প্রতি যে দায়িত্ব তা পালন করা। প্রয়োজনীয় সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কাজ সমূহ সম্পাদন এবং প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করা।
অষঁসহঁং শব্দটি খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে রোমান আইনে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শব্দ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন গুরুগৃহে অবস্থান করে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদেরকে ‘অ্যালামনাই’ বলা হতো। সেকালে এই একটিমাত্র অর্থ প্রকাশের জন্যই শব্দটি ব্যবহৃত হতো। নবম শতকের প্রথম দিকে ধষঁসহর শব্দটির অর্থ বিবর্তিত হয়ে এর অর্থ হয়ে যায় প্রাক্তন শিক্ষার্থী। ১০৮৮ সালে একটি ছাত্র সংগঠন সংস্থা ইতালির বোলোনিয়া শহরে বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (টহরাবৎংরঃু ড়ভ ইড়ষড়মহধ) প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠাকালের ভিত্তিতে মরক্কোর ফেজ শহরে অবস্থিত আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় বলা হলেও ডিগ্রি এবং উচ্চশিক্ষা প্রদানের ভিত্তিতে ইতালির বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়। বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরবর্তীতে ইউরোপে অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বল্প পরিসরে একটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (অষঁসহর অংংড়পরধঃরড়হ) প্রতিষ্ঠা করে। ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনই বিশ্বের প্রথম অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। এরপর ইংল্যান্ডে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আধুনিক অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়।
অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন এর যথার্থ গুরুত্ব অনুধাবন করে একটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠনের সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের ৬৪ তম সভার সুপারিশক্রমে ২৪ আগস্ট, ২০২১ ইং তারিখে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ৮৪ তম সভায় বিএসএমএমইউ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবং এর মাধ্যমেই বিএসএমএমইউ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এরপর প্রায় এক বছর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ব্যাপারে বেশ কয়েকটি আলোচনা ও মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব আলোচনা ও মত বিনিময় সভার সিদ্ধান্তক্রমে ২৪ এপ্রিল, ২০২২ ইং তারিখে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। যার সভাপতি হিসেবে আমি ও সদস্য সচিব হিসেবে ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ (সবুজ) দায়িত্বভার গ্রহণ করি। (অদ্যাবধি এই কমিটিই কার্যকরভাবে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রম পরচালনা করছেন) এবং অ্যাসোসিয়েশনের পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণ করি। আহ্বায়ক কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে ২৭ জুন, ২০২২ ইং তারিখে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ‘মেম্বারশিপ ড্রাইভ’ কার্যক্রমের শুভ সূচনা হয়।
দাপ্তরিক কর্মকান্ডের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য একটি নিজস্ব অফিসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় ও সদস্য সচিবের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন বি-ব্লকের পঞ্চম তালায় ৪১৮ নং রুমে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের অফিস স্থাপিত হয় যা ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ইং তারিখে আমি নিজে উদ্বোধন করি। প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধিভুক্ত যেকোন প্রতিষ্ঠান হতে যেকোনো বিষয়ে মেডিকেল পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভকারী চিকিৎসক এবং প্রাক্তন আইপিজিএমএন্ডআর এর অধীনে এমবিবিএস, বেসিক সাইন্সে অনার্স ও মাস্টার্স এবং ডিপ্লোমাসহ যেকোনো মেডিকেল ডিগ্রি সম্পন্ন করা সকলকেই এই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে ৭০ তম একাডেমিক কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে ১৪ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে অনুষ্ঠিত ৯১ তম সিন্ডিকেট সভায় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যপদের ব্যাপারটি সংশোধন করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টিদেরও এর স্থায়ী সদস্য করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রম শুরু হবার পর থেকেই এই অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয় এবং এলক্ষ্যে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যদের সমন্বয়ে এবং ঢাকাস্থ বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ও বিভিন্ন মেডিকেল ইন্সটিটিউটের প্র্রধানগণকে উপদেষ্টা রেখে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির পরামর্শক্রমে একটি পুনর্মিলনী আয়োজন কমিটি গঠিত হয় যার সভাপতি হন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপ- উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান খান ও সদস্য সচিব হন মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. আবু নাসার রিজভী।
কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যার প্রধান অতিথির পদ অলংকৃত করার জন্য সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন মহান জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার ডা. শিরিন শারমিন চৌধুরী। অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম বড় কার্যক্রম হিসেবে এই প্রথম পুনর্মিলনী সফলভাবে আয়োজনের বিশাল কর্মযজ্ঞ সুন্দর ও মসৃণভাবে এগিয়ে চলেছে। প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, অন্যান্য সকল অতিথি এবং সম্মানিত অ্যালামনাইদের অংশগ্রহণে ২৮ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে একটি প্রাণোচ্ছল পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত হবে, স্বপ্নযাত্রার সফল একটি আনুষ্ঠানিক সূচনা হবে বিএসএমএমইউ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের এ আমাদের আশা নয়, বিশ্বাস। আজ আমাদের নতুন পথ চলার শুরু, আপনিও আমাদের এক স্বপ্নসারথী। জয় হোক বিএসএমএমইউ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের-এ জয় হোক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ।
এলামনাই এসোসিয়েশন একটি প্রতিষ্ঠানের অংশ, এটি ফেলে আসা প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষার্থীকে একটি নির্দিষ্ট স্থান করে দেয় যাতে করে প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিষ্ঠানের প্রতি যে দায়, তা শোধ করার সামান্য সুযোগটুকু পায়। এলামনাই এসোসিয়েশনের প্রয়োজনীয়তা হলো, প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে, বিপদেআপদে সবাইকে পাশে পাওয়া এবং স্কুলের স্বার্থ রক্ষার্থে একজোট হয়ে কাজ করা। বর্তমান যুগ হচ্ছে কানেক্টিভিটির যুগ। যার সঙ্গে যত বেশি মানুষের জানাশোনা তার তত বেশি কানেক্টিভিটি এবং বিপদেআপদে সাহায্য করারও মানুষ বেশি। তাই এসোসিয়েশনের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হলো, সকল প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষতা সাধনে এবং এর মানকে উন্নত ও যুগোপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের একটা বড় ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে। অ্যালামনাইয়ের অনুজ সদস্যগণ অগ্রজদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়, তাদের সাহচর্য ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে নিজেকে গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সমাজ, দেশ ও বিশ্বব্যাপী অ্যালামনাইয়ের আনুভূমিক, সমান্তরাল ও খাঁড়া যোগাযোগের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়ে, কাছে থেকে দূরে সম্পর্কের বন্ধন মজবুত হয়।
ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাপী এই সুসম্পর্কের জাল বিস্তৃত হয় এবং বিশ্বমানব এর সুফল উপভোগ করে। যে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন মজবুত ও কার্যকর, সে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক প্রভাব বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বিএসএমএমইউ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন শুধুমাত্র বিএসএমএমইউ-সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রদান ও আধুনিকীকরণ-সংক্রান্ত বিষয়ে উৎকর্ষতা সাধনই নয়, বরং অক্সনিয়ান-দের মতো বিশ্বব্যাপী ইতিবাচক প্রভাব রাখবে সে প্রত্যাশা করি। ইতোমধ্যেই বিএসএমএমইউ’র অ্যালামনাই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিশ্বমানবের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের কাছে তার ডাটাবেজ নাই। অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আরও সংগঠিত হয়ে কাজ করলে অদূর ভবিষ্যতে একটা ডাটাবেজ তৈরি করে তার হালনাগাদ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা সম্ভব। লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।