বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন প্রতিরোধ অর্থনীতি রক্ষার অন্যতম বড় হাতিয়ার
সুুব্রত বিশ্বাস
বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ অনুযায়ী, রিজার্ভ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব সম্পদ। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মতো দেশে রপ্তানির তুলনায় আমদানি সবসময় বেশি হয়। ফলে এক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেশি থাকা দরকার। মূলত বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা ভাণ্ডার বলতে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বা মুদ্রাবিষয়ক কর্তৃপক্ষের কাছে বৈদেশিক মুদ্রায় গচ্ছিত সম্পদের মজুতকে বোঝায়। পণ্য ও সেবা রপ্তানি ও বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের স্বদেশে পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স থেকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত গড়ে ওঠে। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত আমানত হিসাবে নেয়া মোট অর্থের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। এটাকে বলে রিজার্ভ। কিন্তু এই অর্থ তারা ঋণ বা অন্য কোনো কাজে খরচ করতে পারে না। এটা গ্যারান্টি হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। আর অন্যদিকে রপ্তানি, রেমিট্যান্স, ঋণ বা অন্যান্য উৎস থেকে আসা মোট বৈদেশিক মুদ্রা থেকে আমদানি, ঋণ ও সুদ পরিশোধ, বিদেশে শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি নানা খাতে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা বাদ দেয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিত বা জমা থাকে, সেটাই মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন প্রতিরোধ করার জন্য দেশগুলি মুদ্রার ব্যবহার ও বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত সঠিক নীতি, অর্থনৈতিক নৈতিকতা বজায় রাখা হাতিয়ার হিসেবে স্থিতি উন্নত করতে, রাষ্ট্রের অর্থনীতির সহিষ্ণুতা ও স্থায়িতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে অনেকগুলি কারণ রয়েছে, বৈশ্বিক বাণিজ্যিক প্রস্তুতি, বৈদেশিক মুদ্রা অপর দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এটি দেশের বাণিজ্যিক প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক স্থিতি বজায় রাখা একটি দেশ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রাখতে পারে এবং তার আর্থিক স্থিতি বজায় রেখে একটি প্রতিষ্ঠান দেখতে পারে। বাজার মূল্য নির্ধারণ, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত একটি দেশের মুদ্রা মানের প্রভাব ফেলতে পারে এবং বাজার মূল্য নির্ধারণে সাহায্য করতে পারে। আর্থিক নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আর্থিক নিয়ন্ত্রণে মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে এবং উচ্চ হারের মুদ্রা বা নীচের মুদ্রাসহ মোট অর্থনৈতিক স্থিতি বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত একটি দেশের আর্থিক স্থিতির নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং সম্প্রসারণের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারে।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুত একটি দেশের আর্থিক উন্নতি ও ভূমিকা বৃদ্ধির জন্য একটি উপায় হিসেবে কাজ করতে পারে। এই কারণে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত একটি দেশের অর্থনীতির গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এটির ব্যবহার সত্ত্বেও সঠিক নীতি অনুসরণ করতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার মানে হলো দেশটির যথেষ্ট আমদানি সক্ষমতা আছে, অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য। বিশ্বায়নের কারণে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের বিভিন্ন ধরনের আমদানি-রপ্তানি বৈদেশিক বিনিয়োগসহ নানা লেনদেন করতে হয়। যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা দেশের একটি বড় অর্থনৈতিক ভিত্তি ও শক্তি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যথেষ্ট থাকলে সেটা একটা স্বস্তির কারণ হয়। তখন আমদানি ব্যয় মেটানো যেমন সহজ হয়, তেমনি বৈদেশিক ঋণের সুদ প্রদান প্রভৃতি কাজেও ব্যবহƒত হয়। অর্থনীতির তত্ত্বেও বলা হয়, একটা দেশের তিন মাসের আমদানির খরচের সমমানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবশ্যই থাকতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রার যথেষ্ট সঞ্চয় যদি থাকে, তখন বৈদেশিক ঋণ নেয়ার সময় চিন্তা করতে হয় না এবং সহজে ঋণও পাওয়া যায়। পাশাপাশি অনেক ব্যবসায়ীও বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে। সেটাও বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। যেসব আমদানি করা হয়, সেই আমদানির মূল্য বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়।
সেটার জন্য যেকোনো দেশের যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় থাকা দরকার। ফলে আমদানি নিয়েও চিন্তা করতে হয় না। সাধারণত শক্তিশালী বা অনমনীয় মুদ্রা যা আন্তর্জাতিক বাজারে সহজে বিনিময়যোগ্য (যেমন মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, ইয়েন প্রভৃতি) সেটিতেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুত গড়ে তোলা হয়। এভাবে গচ্ছিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রধানত আমদানি মূল্য এবং বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ প্রভৃতি পরিশোধ করতে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের বেশিরভাগ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত মার্কিন ডলারে সংরক্ষিত। বৈদেশিক মুদ্রাভিত্তিক সম্পদ বলতে বৈদেশিক ব্যাংকের টাকার নোট, বন্ড, ট্রেজারি বিল ও অন্যান্য সরকারি সিকিউরিটি হতে পারে। সোনার মজুতকেও এর আওতায় গণ্য করা হয়। বিশ্বব্যাপী কভিড মহামারির কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতি এবং সেইসঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী যে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে, তার ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎসের মধ্যে আছে রপ্তানি, প্রবাসী আয়, বৈদেশিক বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান প্রভৃতি। কোনো কারণে অতিরিক্ত দেশিয় মুদ্রার প্রয়োজন হলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে প্রিন্ট করে সরবরাহ করা যায়, কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। বৈদেশিক মুদ্রা শ্রম বা রপ্তানির মাধ্যমে আয় করে আনতে হবে,
অথবা ঋণ ও অনুদান হিসাবে পেতে পারে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার বড় একটি অংশ আসে রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টশিল্প থেকে। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে প্রবাসী বাংলাদেশি ও গার্মেন্ট কর্মীরা। আর অন্যদিকে ব্যয়ের বড় জায়গা হচ্ছে আমদানি ব্যয়, নানা ধরনের ঋণ ও দায় পরিশোধ এবং দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে কর্মরত ঠিকাদারদের পাওনা পরিশোধেও বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়। এর বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চাঁদা দেয় বাংলাদেশ। রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি লিখিত নির্দেশনা আছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ক্যালকুলেশনে আট বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অতিমূল্যায়ন হয়েছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ হিসাব করার সময় আইএমএফের মডেল বা গাইডলাইন অনুসরণ করছে না। ফলে কিছু সূত্র থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা বা যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এরই মধ্যে প্রদানের জন্য অঙ্গীকার (কমিটমেন্ট) করা হয়েছে, সেসব বৈদেশিক মুদ্রাও রিজার্ভ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর এ কারণেই রিজার্ভ ক্যালকুলেশনে এই গরমিল দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকও আইএমএফের এই অভিযোগ মেনে নিয়েছে এবং তাদের এই মর্মে আশ্বস্ত করেছে যে এখন থেকে রিজার্ভ ক্যালকুলেশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের মডেল ও গাইডলাইন কঠোরভাবে মেনে চলবে। মুদ্রার মজুত ব্যবহার করে বাজারের ঘাত প্রতিরোধ রক্ষা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ অন্য দেশের নানা ধরনের সরকারি পেপারে বা ঝুঁকিহীন উচ্চ ঋণমানের সার্বভৌম বন্ডে বিনিয়োগ করে। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে আট কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১০ কোটি টাকা) অর্থ চুরি হয়েছিল। এই ডলারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট বা ভল্ট থেকে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশের রিজার্ভ ডলার থেকেই হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে জালিয়াতি করে নেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যূনতম বাজার ঝুঁঁকিতে সর্বোচ্চ স্বল্পমেয়াদি রিটার্ন নিশ্চিত করতে রিজার্ভ-সম্পর্কিত বিনিয়োগের সিদ্ধান্তগুলো সাবধানতার সঙ্গে গ্রহণ করে। লেখক: ব্যবসায়ী