কোচিং ব্যবসা কেন জনপ্রিয় হলো তার মূল কারণ খোঁজে না কেউ
অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
সন্তানের প্রতি কার ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি। মায়ের ভালোবাসা। প্রতিটি ঘরের মা হলো সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি। সন্তানের লেখাপড়ার জন্য যে মানুষটা সবচেয়ে বেশি কষ্ট করে সে হলো মা। প্রতিটি স্কুলের সামনে মায়েদের দেখবেন পাটি বিছিয়ে সন্তানের স্কুল ছুটির অপেক্ষায় বসে আছে। অন্য মায়েদের সঙ্গে গল্প করছে। কেউ কেউ বাড়তি আয়ের জন্য ওখানেই ছোটখাটো ব্যবসাও করছে। এই মায়েরাই বিকালে আবার কোচিং সেন্টারে নিয়ে যায়। এই মায়েদের স্যাক্রিফাইসটা একটু এপ্রিসিয়েট করতে শিখুন। লেখাপড়ার মান নামার জন্য মায়েদের দোষ দিচ্ছেন, কোচিং সেন্টারের দোষ দিচ্ছেন। কিন্তু নিজেদের দোষ দেখছেন না। আপনারা যে শিক্ষায় পৃথিবীতে সর্বনিম্ন বরাদ্দ দিচ্ছেন সেইটা দেখেন না, আপনারা যে শিক্ষায় রাজনীতি ঢুকাচ্ছেন সেইটা দেখেন না, আপনারা যে বাংলাদেশকে পৃথিবীতে সবচেয়ে শিক্ষকদের সবচেয়ে কম বেতন দেশ বানিয়েছেন সেইটা দেখেন না। আমি আমার স্ত্রীকে দেখি। কন্যাকে নিয়ে গুলশান যাচ্ছে। কারণ মেয়ে বাস্কেট বল খেলবে, কোচিংয়ে যাচ্ছে। কারণ ওখানে ভালো শিক্ষক আছে। ওতো ইউরোপিয়ান। তাহলে দেখতে পাচ্ছেন মায়েরা ইউনিভার্সাল হয়। পৃথিবীর সকল মায়ের সন্তানের প্রতি ভালোবাসায় কতটা মিল? তাদের স্যাক্রিফাইস কতোটা ইউনিভার্সাল।
বাংলাদেশের এতো এতো ছেলেমেয়েরা যে প্রতি বছর আন্ডার গ্রাজুয়েট লেভেলে বিদেশে যায়, দেশের মেডিকেল, বুয়েট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় সেটা এই মায়েদের জন্যই। সরকারের কোনো ক্রেডিট নেই। সরকার যদি স্কুলের মান, শিক্ষকদের মান উন্নত করায় মনোযোগ দিতো তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা ম্যাজিক্যাল সাফল্য দেখাতো। আমাদের সরকার তো বাংলা মাধ্যমের কোনো ভালো স্কুল বা কলেজ বানাতে পারেনি। বরং আগে যেই কয়েকটা ভালো ছিল সেগুলোর মধ্যে রাজনীতি আর দলান্ধতা ঢুকিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। এখন আছেই কয়েকটা মিশনারি স্কুল কলেজ। স্কুলেতো পড়াশোনা হয় না। স্কুলে ভালো মানের শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হয় না। বাধ্য হয়ে মায়েরা কোচিংয়ে পাঠায়।
আমাদের মন্ত্রী আমলা এমনকি অনেক সাধারণ মানুষও কোচিংয়ের সমালোচনা করে। যেন কোচিং ব্যবসা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নষ্ট করে ফেলেছে। কিন্তু কোচিং ব্যবসা কেন জনপ্রিয় হলো তার মূল কারণ খোঁজে না কেউ। স্কুলের শিক্ষকদের ভালো বেতন দেবেন না। শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করবেন না। তাহলে মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসবে কেন? আসলে আর্থিক অনটনে ভোগে, ম্যানেজমেন্ট কমিটি দ্বারা পিষ্ট হয়। এতো কম বেতন পায় যে তারা কেবল স্কুল থেকে পাওয়া বেতন দিয়ে সংসার চালাতে সক্ষম না। তারা বাধ্য হয়ে প্রাইভেট পড়ায়। প্রাইভেট পড়াতে হলে এনার্জি সেভ করতে হবে এবং একই সাথে কম পড়িয়ে বাচালাকি করে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করতে হবে। মূল কথা হলো স্কুলে ভালো পড়ানো হয় না। তাহলে কোচিংয়ে যেতে হবে।
আমি লক্ষ্য করেছি আমাদের কোচিংয়ে অনেক ভালো মানের দারুণ দারুণ শিক্ষক আছে যারা বুয়েট বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করে এই কোচিং ব্যবসায় জড়িয়ে গিয়ে সুনাম অর্জন করেছে। কোচিংকেই তারা পেশা হিসাবে নিয়েছে। তারা তো পড়িয়েই টাকা নেয়। অনেক কোচিং শিক্ষক অনেক শিক্ষার্থীকে বদলে দিয়েছে। তারা অনেক কেয়ার নেয় যে আসলে স্কুল থেকেই পাওয়ার কথা। কোচিংকে ব্লেইম না করে, মায়েদের ব্লেইম না দিয়ে এই সমস্যার মূলটা কোথায়। সেই মূল রিপেয়ার না করে কারিকুলাম পরিবর্তন করে, পরীক্ষার সিস্টেম পরিবর্তনে হাত দিলেন। এর মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার মানকে নামিয়ে দিয়ে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার কথা ভাবছেন। এইসব আকাম করতে গিয়ে ফিনল্যান্ড বা জাপানের উদাহরণ দিলেন। এসব দেশের উন্নত শিক্ষাকে উদাহরণ হিসাবে মানুষের সামনে তুলে ধরে ক্যামোফ্লেজ করে অষ্টম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত শিক্ষাকে একদম ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার কারিকুলাম বানালেন। আনন্দের সঙ্গে লেখাপড়া, খেলাধুলার সঙ্গে লেখাপড়া, প্রাকটিক্যাল লাইফকে জানা, সিভিক সেন্স দেওয়া, নাচ গান ও দলগতভাবে কাজ করা শেখানো ইত্যাদি পঞ্চম বা বড়জোর ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত একদম ঠিক আছে। ফিনল্যান্ড জাপানেও তাই করে। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেতো সিরিয়াস লেখাপড়া শুরু হয়। আমার আপত্তির বড় জায়গাটা কোথায়? সেটা হলো নবম ও দশম শ্রেণিতে ঘাড়ে ধরে কোনো অপশন না দিয়ে সবাইকে ১০টি সাবজেক্ট পড়তে বাধ্য করা। কেন? আমাদের ছেলেমেয়েরা কি সবাই একরকম? আমার বড় কন্যা আর ছোট কন্যা তো নানাদিক থেকে বিপরীত মেরুর। বড়জন জন্মগতভাবেই ছবি আঁকায় ভালো কিন্তু অন্যজন শত চেষ্টায়ও ওর কাছাকাছি যেতে পারে না। আবার ছোটজন জন্মগতভাবেই মিউজিক ও খেলাধুলায় খুব ভালো এবং উৎসাহও বেশি। এরকম খাবার দাবারের টেস্ট থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই তাদের মধ্যে ইনহেরেন্ট পার্থক্য লক্ষ করেছি। এই পার্থক্য বা বৈচিত্রকে নতুন শিক্ষাক্রমে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। এর চেয়ে আগের সিস্টেমে যে বিভাগ বিভাজন ছিল সেটা এর চেয়েও ভালো ছিলো। কারণ তখন অল্প হলেও পছন্দমতো সাবজেক্ট নিতে পারতো। ইংরেজি মাধ্যমেসহ বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত দেশে বিভাগে বিভাজন নেই। কিন্তু এর চেয়েও উন্নত ব্যবস্থা অর্থাৎ যে যার পছন্দমতো সাবজেক্ট নিতে পারে। এমনকি সাবজেক্ট সংখ্যাও ইচ্ছেমত নেওয়া যায়। এইটা আমাদের মজ্জাগত যে খারাপ কিছু হলে তার জন্য অন্যকে দোষ দেওয়া, সকল ভালো কিছুর জন্য সকল ক্রেডিট হাইজ্যাক করা। লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়