কপ-২৮ : নীট শূন্য নির্গমন অর্জনের জন্য কি আমাদের হাতে পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত সমাধান আছে?
ড. কানন পুরকায়স্থ : ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) এর কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিস (কপ-২৮) এর ২৮তম অধিবেশন ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত দুবাইয়ের এক্সপো সিটিতে অনুষ্ঠিত হবে। ২০২২ সালে মিশরে অনুষ্ঠিত কপ-২৭ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি প্রদান করেছে। এছাড়াও আমরা কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি, যা কপ-২৮ এ জলবায়ু পরিবর্তনের এজেন্ডা গঠনে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইন প্রণয়ন করেছে, যা পরবর্তী দশকে পরিচ্ছন্ন শক্তি, পরিচ্ছন্ন অবকাঠামো, জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে মার্কিন অর্থনীতিতে প্রায় ৩৭০ বিলিয়ন ডলার পাবলিক খরচ ও ট্যাক্স ক্রেডিট ইনজেক্ট করবে। অস্ট্রেলিয়া একটি জলবায়ু-সমর্থক সরকারকে নির্বাচিত করেছে, যা দ্রুত দেশের জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে কিছু আইন প্রণয়ন করেছে। ব্রাজিলে নতুন রাষ্ট্রপতি আমাজন বন উজাড় বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কপ-২৭ এ বিভিন্ন দেশ নতুন অর্থায়নের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সম্মত হয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে সাহায্য করার জন্য সম্পদ একত্রিত করতে পারে।
একই সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে গ্রিনহাউস গ্যাস (জিএইচজি) নিঃসরণ উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় জলবায়ু সংকট আরও তীব্র হয়েছে, পাকিস্তান, চীন ও ভেনিসে বিপর্যয়কর বন্যা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড-ব্রেকিং তাপপ্রবাহ, ইউরোপ, আফ্রিকায় তীব্র খরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মেরুতে রেকর্ড বরফ গলছে। রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমণের মতো ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে এই সমস্যাগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ইউরোপকে তার নিজস্ব জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতার অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার পরিণতি দিতে বাধ্য করছে ও কিছু স্বল্পমেয়াদী সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে। এই সিদ্ধান্তগুলোর অর্থ দেশগুলো ক্রমবর্ধমান শক্তির দাম থেকে দ্রুত মুক্তি পাওয়ার জন্য নোংরা অবকাঠামো ব্যবহার করবে। ক্রমবর্ধমান শক্তির দাম ও খরা ইউক্রেন থেকে কৃষি রপ্তানি হ্রাসের সংমিশ্রণ বিপজ্জনকভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এটি কপ-২৮ এ প্রদর্শনের জন্য দেশগুলোর উপর চাপ বাড়াবে যে তারা প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যগুলো নাগালের মধ্যে রাখতে অবিলম্বে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেবে।
কপ-২৮ এ বিশ্বব্যাপী ‘স্টকটেকিং’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশগুলোকে কপ-২৮ এ রিপোর্ট করতে হবে। অভিযোজনের উপর নতুন বৈশ্বিক লক্ষ্য কী? এটি ক্ষতির জন্য অর্থের সঙ্গেও সম্পর্কিত। দেশগুলো যদি ট্র্যাকে না থাকে, তাহলে কী করবেন? নির্গমন লক্ষ্য একটি দেশের জন্য প্রযুক্তির প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে। নেট শূন্য নির্গমন অর্জনের জন্য কি আমাদের হাতে পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত সমাধান আছে? কপ-২৭ এ দেশগুলো এই নতুন ক্ষয়ক্ষতি সুবিধা প্রতিষ্ঠা করতে তদনুসারে অর্থায়নের অন্যান্য উপায় ও চ্যানেলগুলো সংগঠিত করার জন্য নিজেদেরকে একবছর সময় দিয়েছে। অন্য সমস্যা হলো কীভাবে উন্নত অর্থনীতিগুলো উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলার সরকারী ও বেসরকারী জলবায়ু অর্থ সংগ্রহের থ্রেশহোল্ডে পৌঁছতে পারে। একটি থ্রেশহোল্ড যা তারা ২০২০ সালের শুরুতে বার্ষিক পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এখনও তা পূরণ করতে পারেনি। এটি বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বার্ষিক সভার ফলাফলের উপর নির্ভর কওে, যা আগামী বছর মরক্কোতে অনুষ্ঠিত হবে।
কৃষি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। কিন্তু ক-২৭ এ আমরা খাদ্য ও কৃষি খাত থেকে জিএইচজি নির্গমন নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ লক্ষ্য করেছি। কারণ এই খাত মোট জিএইচজি নির্গমনের এক তৃতীয়াংশ অবদান রাখে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ঘোষণা করেছে যে এটি খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থা থেকে নির্গমন কমাতে কপ-২৮ এর আগে একটি পরিকল্পনা তৈরি করবে। জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমনে খাদ্য খাতকে সমর্থন করার জন্য মহাসাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই অবৈধ মাছ ধরার বিরুদ্ধে লড়াই, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র রক্ষা ও পুনরুদ্ধার করার জন্য নবায়ন প্রচেষ্টা সমুদ্র-ভিত্তিক জলবায়ু কর্মকে উন্নীত করা। যেমন ডিকার্বোনাইজিং শিপিং এবং অফশোর পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য যে ক্ষয়প্রাপ্ত উপকূলরেখা মোকাবেলায় ম্যানগ্রোভ বন পুনরুদ্ধারের জন্য ফিজিতে বেশ কয়েকটি ম্যানগ্রোভ পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমিত করতে সাহায্য করবে। এ ধরনের উদাহরণ অন্যান্য দেশের অনুসরণ করা প্রয়োজন।
আইপিসিসি-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইতোমধ্যেই তীব্র জলবায়ু-জ্বালানিযুক্ত খাদ্য ও জলের নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অগ্রগতি অসম, খণ্ডিত ও মানুষের দুর্ভোগে জীবনহানি রোধে অপর্যাপ্ত। আইপিসিসি পর্যবেক্ষণ করেছে যে ‘এই প্রভাবগুলো মোকাবেলায় চ্যালেঞ্জের অংশ হলো স্থিতিস্থাপকতার জন্য অর্থায়নের অভাব। কারণ উপলব্ধ অর্থ প্রয়োজনীয়তার প্রায় ১০ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রথম সারিতে থাকা ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এটি কপ-২৮ এ সম্বোধন করা উচিত।
সর্বোপরি ২০২২ সালে আইপিসিসি তার ষষ্ঠ মূল্যায়ন চক্রের অংশ হিসাবে দুটি বড় রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অভিযোজন ও দুর্বলতা সম্পর্কিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে বিশ্ব জলবায়ু-নিরাপদ ভবিষ্যৎ অর্জনের পথে নেই। জলবায়ু পরিবর্তন ইতোমধ্যেই কোটি কোটি মানুষ বাস্তুতন্ত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে জলবায়ু সংকটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাবগুলো নির্মূল করার জন্য, যা প্রয়োজন তা থেকে পিছিয়ে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে ২০১০ থেকে ২০১৯ এর দশকে মানব ইতিহাসে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের সর্বোচ্চ বৃদ্ধি ছিলো, কিন্তু যখন উষ্ণতাকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করার উইন্ডোটি দ্রুত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন সীমাবদ্ধ করার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যকর কৌশল রয়েছে। সুতরাং নির্গমন নিয়ে আমাদের এখনই কাজ করা উচিত।
লেখক : যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একাডেমিক বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদ। সূত্র : ডেইলি সান। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ