দেশে কি খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে?
আসজাদুল কিবিরা : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশের খাদ্য ব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির মধ্যে এসেছে। একটি ইঙ্গিতও রয়েছে যে অদূর ভবিষ্যতে ঝুঁকি বাড়বে, যার অর্থ আগামী দিনে আরও বেশি লোক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হতে পারে। ‘খাদ্য ব্যবস্থার ঝুঁকির উপর অন্তর্দৃষ্টি (আইএনএফইআর) শিরোনামের একটি নতুন প্রবর্তিত কাঠামো যা খাদ্য ব্যবস্থার বহুমাত্রিক ঝুঁকির অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, সমস্যাটিকে সামনে নিয়ে এসেছে। ইউনাইটেড নেশনস ইকোনোমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক (ইএসসিএপি) এবং ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) দ্বারা যৌথভাবে প্রস্তুত, আইএনএফইআর সূচক খাদ্য ব্যবস্থার ঝুঁকির স্কোর প্রোফাইল তৈরি করতে ৯৫টি সূচক ব্যবহার করে। সুতরাং এটি খাদ্য ব্যবস্থার জন্য বহুমাত্রিক হুমকির পরিমাণ বুঝতে সহায়তা করে।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই) অনুসারে খাদ্য ব্যবস্থা হলো ‘খাদ্য মূল্য শৃঙ্খল বরাবর কার্যক্রম ও মিথস্ক্রিয়াগুলোর সমষ্টি’। খাদ্য মূল্য শৃঙ্খলে ফসল, পশুসম্পদ, মাছ ও অন্যান্য কৃষি পণ্য পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ, খুচরা, পাইকারী, খাওয়া ও নিষ্পত্তির জন্য খাদ্য প্রস্তুত করার জন্য ইনপুট সরবরাহ উৎপাদন অন্তর্ভুক্ত। আইএফপিআরআই-এর সংজ্ঞা অনুসারে, খাদ্য ব্যবস্থায় খাদ্যের আশেপাশে সহায়ক নীতি পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সুতরাং একটি আদর্শ খাদ্য ব্যবস্থার অধীনে, মানুষ একটি উৎপাদনশীল ও কার্যকর উপায়ে পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ পর্যাপ্ত খাবারের আরও ভালো অ্যাক্সেস পায়। খাদ্য উৎপাদন পরিবেশগতভাবে টেকসই, জলবায়ু-স্মার্ট, অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া উচিত। সংক্ষেপে একটি দক্ষ খাদ্য ব্যবস্থা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মূল চাবিকাঠি, যা পর্যাপ্ত পুষ্টি ও সুস্থতার সঙ্গে বিশ্ব ও জাতীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহের প্রাপ্যতা বোঝায়।
স্পষ্টতই বাংলাদেশসহ অনেক দেশ এখনও জড়িত বিভিন্ন ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য একটি আদর্শ খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। খাদ্য ব্যবস্থার ঝুঁকি প্রশমিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, এর জন্য সিস্টেমের একাধিক মাত্রার ব্যাপক বোঝার প্রয়োজন। যদিও বাংলাদেশ ৯০-এর দশকের শেষের দিকে চালের উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। গত দশকে মাছ, শাকসবজি ও ফলের মতো অন্যান্য অনেক খাদ্যদ্রব্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, তবুও এটিকে এগিয়ে যেতে হবে। আইএনএফইআর ফ্রেমওয়ার্ক বা সূচক প্রতিটি দেশের সামগ্রিক খাদ্য ব্যবস্থার ঝুঁকির স্কোর গণনা করে অঞ্চলজুড়ে কাউন্টিতে খাদ্য ব্যবস্থার ঝুঁকির পরিমাণ চিহ্নিত করেছে। সামগ্রিক স্কোর যত বেশি হবে, দেশের খাদ্য ব্যবস্থা ততো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সামগ্রিক স্কোর গণনা করা হয় তিনটি ঝুঁকির মাত্রার পণ্যগুলোর সমান ওজন রেখে (১) বিপদ ও এক্সপোজার, (২) দুর্বলতা (৩) অভিযোজিত ক্ষমতা। ঝুঁকি ও এক্সপোজারের অধীনে তিনটি প্রধান বিভাগ রয়েছে, যথা প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক। দুর্বলতা অভিযোজিত ক্ষমতা নামে অন্য দুটি ঝুঁকির মাত্রার জন্য ছয়টি সাধারণ বিভাগ রয়েছে। এগুলো হলো প্রাপ্যতা, এক্সেস, ব্যবহার, স্থিতিশীলতা, সংস্থা ও স্থায়িত্ব। তিনটি ঝুঁকি মাত্রার সমস্ত বিভাগের অধীনে, খরা, জলের চাপ, খাদ্য মূল্যস্ফীতি, আর্থিক ব্যবস্থা ইত্যাদির মতো ৪১টি উপাদান রয়েছে। সামগ্রিকভাবে আইএনএফইআর তিনটি খাদ্য ব্যবস্থার ফলাফলের ঝুঁকি পর্যালোচনা করে নির্ধারণ করে। এগুলো হলো : (১) মানুষের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি (২) ভাগ করা সমৃদ্ধি (৩) বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য ও স্থায়িত্ব।
নতুন প্রবর্তিত সূচকের ফলাফল বোধগম্য কারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। সূচকটি দেখায় যে আফগানিস্তান গত বছর তার সামগ্রিক খাদ্য ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছিল, যথাক্রমে পাকিস্তান ও ইরান অনুসরণ করেছে। তুর্কমেনিস্তান পাপুয়া নিউগিনি অনুসরণ করে শ্রীলঙ্কা সাধারণ খাদ্য ব্যবস্থার ঝুঁকির তালিকায় চতুর্থ হয়েছে। সূচকে ভারত ও বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে সপ্তম ও অষ্টম, এরপর মঙ্গোলিয়া ও মিয়ানমার। সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৪৬.১৬। এইভাবে গত বছর উচ্চতর খাদ্য ব্যবস্থার ঝুঁকির সম্মুখীন দশটি শীর্ষ দেশের মধ্যে পাঁচটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার।
বিগত বছরগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি খাদ্য ব্যবস্থার ঝুঁকির ক্ষেত্রে উন্নতির ইঙ্গিত দেয়। ২০০০ সাল থেকে সুনির্দিষ্ট হওয়ার জন্য গত দুই দশকে দেশের সামগ্রিক ঝুঁকি প্রায় ১১.৭৪ শতাংশ কমেছে। বিপদ এক্সপোজারের ঝুঁকির মাত্রাও প্রায় ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে অভিযোজিত ক্ষমতার অভাবের জন্য, যা ১৩.২০ শতাংশ কমেছে। দুর্বলতা-সম্পর্কিত ঝুঁকিও ২০০০ সাল থেকে ৬.৭৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এই সমস্ত উৎসাহজনক প্রবণতাগুলো খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্ষুধা ও অপুষ্টি কমানোর জন্য দেশের অবিরাম প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করে।
গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই) ব্যবহার করে কেউ দেশের খাদ্য ব্যবস্থার ঝুঁকির অবস্থা বিশ্লেষণ করতে পারে। ২০২৩ সালে ১২৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৮১তম স্থানে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ পাকিস্তান (১০২), ভারত (১১১) আফগানিস্তান (১১৪) থেকে অনেক এগিয়ে। তবে শ্রীলঙ্কা (৬০) নেপাল (৬৯) থেকে অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশের জন্য জিএইচআই স্কোর হলো ১৯.০, যা নির্দেশ করে যে দেশের সামগ্রিক ক্ষুধা পরিস্থিতি মাঝারি স্তরের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। পরিস্থিতির সামান্য অবনতি হলে এটি গুরুতর গ্রুপের প্রথম পর্যায়ে হবে। সুতরাং ক্ষুধা ও খাদ্য ব্যবস্থার ঝুঁকি কমানোর বিষয়ে আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। তাই খাদ্য ব্যবস্থার ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশকে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ২০২০ সালে গৃহীত জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নীতি (এনএফএনএসপি) গুরুত্বপূর্ণ। নীতির পাঁচটি মূল উদ্দেশ্য রয়েছে : (ক) স্বাস্থ্যকর খাদ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা (খ) সাশ্রয়ী মূল্যে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের অ্যাক্সেস উন্নত করা। নীতিটি বৈচিত্র্যময়, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের পর্যাপ্ত সরবরাহ ও ব্যবহারকেও অগ্রাধিকার দেয়। লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনাও তৈরি করা হয়েছে। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, প্রধানত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের কারণে, ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। একটি সমন্বিত প্রশমন ব্যবস্থা গড়ে না উঠলে আগামী দিনে খাদ্য ব্যবস্থার ঝুঁকিও বাড়তে পারে। খাদ্য ব্যবস্থার উন্নতি একটি কঠিন কাজ যার জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সহযোগিতা সহ সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ধংলধফঁষশ@মসধরষ.পড়স. সূত্র : দি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস।
অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ