সায়মা ওয়াজেদ : ধন্যি মেয়ে
ড. আতিউর রহমান
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে সায়মা ওয়াজেদ বিপুল ভোটে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। দশটির মধ্যে আটটি ভোটই তাঁর পক্ষে পড়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কন্যা হিসেবে নয়, তিনি নির্বাচিত হয়েছেন তাঁর মেধা ও পেশাদারি দক্ষতার গুণেই। ইতোমধ্যেই তিনি বাংলাদেশসহ এশিয়া এবং বিশ^জুড়েই অটিজম এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছেন। বিশে^র বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে তিনি অনেক দিন ধরেই উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন। বাংলাদেশেও এসব শিশুদের জন্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার পক্ষে ব্যাপক তথ্য অভিযান গড়ে তুলেছেন। শুধু কথায় নয় কাজেও তিনি সমান পারদর্শী। সুচনা ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছেন এই সব উপকারভোগীদের অধিকার ও বিশেষ সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্য পূরণের অভিপ্রায়ে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে যে ‘ইফ ইউ আর ইন মাউন্টেন থিংক লাইক এ মাউন্টেন’। সায়মা ওয়াজেদ তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্ট করে বলেছেন যে তিনি ‘লোকাল সলিউশনস ফর লোকাল রিয়ালিটিজ’Ñ এ বিশ্বাস করেন। তাঁর এই বাস্তব-ভিত্তিক নীতিকৌশল এখন বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের দেশগুলোতে প্রয়োগ করার সুযোগ পাবেন। এতে বরং এই সংস্থাটির পশ্চিম-ঘেষা ভাবমূর্তির বেশ খানিকটা পরিবর্তন হবে বলে আশা করা যায়। একইসঙ্গে তিনি নির্বাচিত হবার পরপরই বিশ^কে একবার্তায় জানিয়েছেন যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলার সময় তিনি সমাজ বা কমিউনিটি নির্ভর সমাধানের পথ খুঁজবেন। এ থেকেই অনুমান করা যায় তিনি হবেন খুবই অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমাজ অন্তর্গত কৌশলের এক উদ্ভাবনীমূলক নেতা। পরিবর্তনকামী এই নেতা জনস্বাস্থ্য ভুবনে একজন টেকসই রূপান্তরের কারিগর হবার সবগুলো গুণের অধিকারী। প্রতিকূল রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় তিনি সচেষ্টায় বড়ো হয়ে উঠেছেন।
স্বদেশের মাটিতে মাত্র তিন বছরের মতো প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। বাকিটা সময় তিনি ভারতে ও যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন। যুক্তরাজ্যের ফ্লরিডায় এমন এক পরিবেশে উচ্চ শিক্ষা, কর্ম এবং বসবাস করেছেন যাকে সামাজিক ‘মেল্টিংপট’ বললে ভুল হবে না। এখানকার ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি মনস্তত্বে স্নাতক ও ক্লিনিক্যাল মনস্তত্ব স্নাতকোত্তর শিক্ষা নিয়েছেন। স্কুল সাইকোলোজির বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন বিষয়ে গবেষণা করেন। এই গবেষণা-ভিত্তিক যে উপস্থাপনাটি তিনি ফ্লরিডা একাডেমি অব সায়েন্সে পেশ করেছিলেন তা সর্বোত্তম বৈজ্ঞানিক কর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ইউরোপ, এশিয়া, ক্যারিবিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার শিক্ষার্থীদের সাথে মেশার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফলে তার মনে বহু-ভাষী ও বহুমুখী সমাজ এবং সংস্কৃতির জ্ঞান, আচার ও অনুষ্ঠানের সম্ভারের প্রভাব পড়ে। আর বাঙালি সংস্কৃতির শেকড় তাঁর পরিবারেই গাথা আছে। তাই একইসঙ্গে তিনি স্থানীয় ও বৈশ্বিক ব্যক্তিত্ব অর্জনের এক অনাবিল সুযোগ লাভ করেন।
পরবর্তী সময়ে তাঁর পেশাগত জীবনে এই বহুমাত্রিকতা বড় ধরনের শক্তি যুগিয়েছে। একা একা চলা ও বলার এক শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট তিনি অনায়াশেই অর্জন করতে পেরেছেন। ছোটবেলা থেকেই নিরাপত্তার দুঃশ্চিন্তা তাঁর মনে নিশ্চয় ছিল। পরিবার থেকে বহু দূরে আপন বলে বলীয়ান হবার সাহস তিনি সঞ্চয় করেছেন নিজে নিজেই। রাজনীতিক মায়ের সংগ্রাম তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তাই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কী করে এগিয়ে যেতে হয় তা তিনি পরিবার ও জীবন থেকেই শিখেছেন। আর কষ্টার্জিত এই অভিজ্ঞতাই তাঁকে এমন বড়ো মাপের পেশাদারি একজন বিশেষ ধাঁচের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে সাহায্য করেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর এই বহুমাত্রিক মেধা ও দক্ষতা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই আঞ্চলিক পরিচালকের দপ্তরটিকে এক নয়া উচ্চতায় নিয়ে যাবে। সারা বিশ্বে কভিড-১৯ যে তাণ্ডব চালিয়েছে তা থেকে আমাদের স্বাস্থ্য বিষয়ক চিন্তা ও কাজে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা না করে উপায় নেই। আশার কথা নির্বাচিত হবার পরপরই তিনি আগাম জানান দিয়েছেন যে প্যানডেমিক বা অতিমারির এই বিষয়টি তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মোকাবেলা করবেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় তিনি মোটেও নবাগত নন। তিনি এই সংস্থার মহাপরিচালকের মানসিক স্বাস্থ্য ও অটিজম বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে অনেকদিন ধরেই কাজ করছেন। সেই সুবাদেই ২০১১ সালে তিনি ঢাকায় দক্ষিণ এশীয় অটিজম সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। দারুণ সফল সেই সম্মেলনের পর বাংলাদশে অটিজম বিষয়টি সরকারি ও অসরকারি কাজ-কর্মে বিশেষ গুরুত্ব পেতে থাকে। তিনি বাংলাদেশের অটিজম ও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বিষঁযক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নীতি পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। পাশাপাশি তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পঁচিশ সদস্যের মানসিক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসেবেও চার বছর ধরে অবদান রেখেছেন। ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ পুরস্কৃত এই অ্যালমনাই ‘হু চ্যাম্পিয়ন অন অটিজম’ এবং প্রতিবন্ধী মানুষের ডিজিটাল ক্ষমতায়নের জন্য পুরস্কার দেবার লক্ষ্যে ইউনেস্কো কর্তৃক গঠিত আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ডের চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অটিজম বিষয়ক গুড উইল অ্যম্বাসেডর হিসেবে তিনি বিরাট দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছন। লন্ডনের চ্যাটাম হাউস সংগঠিত বিশ্বজনীন স্বাস্থ্য কমিশনেরও তিনি একজন সদস্য।
সারা বিশ্বে যেমন তিনি সক্রিয়, তেমনি বাংলাদেশেও তিনি সমান তালে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের ভাগ্যেন্নয়ন কাজ করে চলেছেন। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে এই বিশেষ শিশুদের অনকূলে কাজ করে বেশ কয়েকটি আইন পাস করতে সাহায্য করেছেন। এদের জন্য যে বিশেষ ধরনের সেবা দরকার তা তাঁর নিরন্তর প্রচেষ্টায় আমাদের দেশীয় এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন নীতি কৌশলে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। দুর্যোগ এলে এসব শিশুদের ওপর বড়ো বিপদ নেমে আসে। তাদের জন্য তাই বিশেষ প্রস্তুতি ও সুযোগের ব্যবস্থা করা দরকার। এ কথাটি সায়মা আমাদের নীতিনির্ধারকদের বেশ ভালোভাবেই বুঝিয়েছেন। আর এই জ্ঞান তিনি বিশ্ব পর্যায়ে শেয়ারও করছেন। জাতিসংঘের অফিস ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডিাকশনের জন্য একটি উপযুক্ত নীতিনির্দেশনা তৈরির ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এভাবেই তিনি সমপূর্ণ পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশের এবং বিশ্বের এসব বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য নিরবে কাজ করে চলেছেন। তিনি খুব বেশি কথা বলেন না। যা বলেন তা স্পষ্ট এবং প্রসঙ্গিক। এক দুটো সভায় সহ-প্যানেলিস্ট হিসেবে তাঁর কথা শুনেছি। আমার বিশ^াস তাঁর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় নেতৃত্ব দেবার সময় খুবই কাজে লাগবে। সারা জীবন ধরে সাধারন মানুষের কল্যাণে, বিশেষ করে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও মানুষের জন্য যে সব ভাবনা ভেবেছেন এবং যা করতে চেয়েছেন এই বেশ খানিকটা বড়ো পরিসরে তা বিস্তবে করে দেখানোর সুযোগ তিনি পাবেন। আশা করছি তাঁর অন্তর্ভুক্তিমূলক দরদী নেতৃত্বের সুদূরপ্রসারি বিকাশের সুযোগ তিনি পাবেন। ভবিষ্যতে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও বড়ো মাপের নেতৃত্ব দেবার মতো পরিবেশ ও পরিস্থিতি নিশ্চয় তৈরি হবে। ভুলে গেলে চলবে না বিভক্ত ভূ-রাজনৈতিক এই টানাপোড়েনমূলক পরিবেশেও তিনি সব ক্যম্পেরই সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন। এটি সম্ভব হয়েছে এতোক্ষণ ধরে তাঁর যে মেধা ও পেশাদারিত্বের কথা বললাম তারই গুণে। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় এখানে মুখ্য ছিল না।
তবে একথাটিও সত্যি যে বাংলাদেশের গতিময় এবং বহুমাত্রিক অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের যে ধারা দেড় দশক ধরে চালু আছে তার স্বীকৃতি সায়মার এই আন্তর্জাতিক অর্জনে নিশ্চয় বেশ খানিকটা প্রতিফলিত হয়েছে। একইসঙ্গে তিনি যে পরিবার থেকে উঠে এসে এই নয়া দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন এদেশের জন্ম এবং তার বিস্ময়কর রূপান্তরে তার অবদান যে অতুলনীয় সে কথাটিও নিশ্চয় উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে তাঁর দৌহিত্রী দুঃখী মানুষের জন্য যে মানবিক কাজ করে করে এমন বিশ্ব সাফল্য অর্জন করলেন নিশ্চয় দেশবাসী তা স্মরণে রাখবেন। তাঁর মার এবং খালার অভিভাবকত্ব এবং মানব কল্যাণের প্রতি তাঁদের যে ঝোঁক সায়মা আজীবন দেখেছেন তাও নিশ্চয় তাঁর এই অর্জনের পেছনে বড়ো অবদান রেখেছে। জাতিসংঘের উঁচু পদে সায়মার এই নির্বাচন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে। এরপর বাংলাদেশের অর্থনীতি যেমন বিকশিত হবে তেমনি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের সফল অভিযাত্রা নিয়ে স্মার্ট বার্তা দেবার আরও নতুন নতুন উজ্জ্বল মুখের সন্ধান মিলবে। তাই বলি ধন্যি মেয়ে। কল্যাণ হোক।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক