আমানতকারীদের ১ শতাংশেরও কম এবং ঋণগ্রহীতাদের মাত্র ১.১ শতাংশ কোটিপতি ব্যাংক খাতের ৪৩.৩৫% আমানত ও ৭৪% ঋণ কোটিপতিদের দখলে
সোহেল রহমান : [১] গত আশির দশক পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে মাঝারি ও ক্ষুদ্র আমানতকারীদের একটা বিশেষ অবস্থান ছিল। এরপর নব্বইয়ের দশক থেকে ব্যাংকগুলোতে কোটিপতি আমানতকারীদের আধিপত্য বাড়তে থাকে। কোটিপতি আমানতকারীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে কোটি টাকার অধিক ঋণগ্রহীতার সংখ্যাও। বর্তমানে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীদের চেয়ে কোটি টাকার ঋণগ্রহীতার সংখ্যা এবং তাদেও গৃহীত ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি।
[২] বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, চলতি পঞ্জিকা বছরের গত জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা এবং মোট আমানতকারীর সংখ্যা হচ্ছে ১৪ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ১৯২ জন। এর মধ্যে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪ জন এবং তাদের মোট আমানতের পরিমাণ ৭ লাখ ৩১ হাজার ৩৩২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। শতকরা হিসেবে কোটিপতি আমানতকারীর হার মোট আমানতকারীর ১ শতাংশেরও কম (০.০৮%) এবং তাদের আমানতের পরিমাণ ব্যাংক খাতে মোট আমানতের ৪৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
[৩] পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট ১৯ হাজার ১৬৩ জন কোটিপতির মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ৭৭ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এটা তখন ছিল ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ গত সাড়ে ১৪ বছরে ব্যাংক খাতে কোটিপতিদের আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। [৪] প্রসঙ্গত: ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ জন। বঙ্গবন্ধু (ডিসেম্বর ১৯৭৫) এবং জিয়া সরকারের আমলে (ডিসেম্বর ১৯৮০) এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৭ ও ৯৮ জনে। সে সময়ে তাদের আমানতের পরিমাণ ছিল ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ১০ শতাংশ। এরশাদ সরকারের পতনের সময় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৩ জন ও আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ শতাংশ। এই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে ১৯৯৬ সালের জুনে কোটিপতির মোট সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৯৪ জন ও আমানতের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ২০ শতাংশ। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে কোটিপতির মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৬২ জন ও আমানতের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ২২ শতাংশ।
[৫] অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, চলতি বছরের গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণগ্রহীতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ ৪১ হাজার ৬২৬ জন। আর তাদের মোট গৃহীত ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ১৪ লাখ ৪৬ হাজার ৭২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১ কোটি টাকার অধিক ঋণ গ্রহীতার সংখ্যা হচ্ছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ১৩৫ জন (এটি মোট ঋণ গ্রহীতার মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ) এবং তাদের গৃহীত ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ১০ লাখ ৭০ হাজার ৫২৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এটা ব্যাংক খাতে মোট ঋণ প্রবাহের ৭৪ শতাংশ।
[৬] পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার প্রাক্কালে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর শেষে কোটি টাকার অধিক ঋণ গ্রহীতার সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার ২০৬ জন এবং তাদের গৃহীত ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণ প্রবাহের সাড়ে ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ গত সাড়ে ১৪ বছরে ব্যাংক খাতে কোটিপতিদের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে ১২ শতাংশ।
[৭] ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, সাধারণ আমানতকারীদের অধিকাংশই ব্যাংকে টাকা রাখেন সঞ্চয়ের জন্য। অন্যদিকে কোটিপতি গ্রাহকদের ক্ষেত্রে সঞ্চয়ের চেয়ে ঋণ গ্রহণের প্রবণতাই বেশি।
[৮] প্রসঙ্গত: ১৯৭৫ সালে দেশে ১ কোটি টাকার অধিক ঋণ গ্রহীতার সংখ্যা ছিল ২১২ জন। ১৯৯০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ১২৫ জনে এবং গৃহীত ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণ প্রবাহের ৩৮ শতাংশ।
[৯] জুন ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের শেষে কোটি টাকা ঋণ গ্রহীতার সংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪ হাজার ৫২৬ জন এবং ৮ হাজার ৮৪৪ জনে। আর আলোচ্য দুই বছরে গৃহীত ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণ প্রবাহের যথাক্রমে ৪৪ শতাংশ এবং প্রায় ৫২ শতাংশ।