ইএফডি মেশিন চালুর পর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট আদায় বেড়েছে মামলায় ও বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকে আছে ৪৭ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট
সোহেল রহমান : [১] মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) সংক্রান্ত মামলার কারণে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রাপ্য বকেয়া ভ্যাট আদায় করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। উভয় হিসাব মিলিয়ে ভ্যাট বাবদ এনবিআর-এর মোট পাওনা আটকে আছে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া, ইনকাম ট্যাক্স ও কাস্টমস ডিপার্টমেন্টের বকেয়া এবং মামলায়ও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আটকে আছে। ওইসব অনিষ্পত্তিকৃত রাজস্বের মধ্যেও বড় অঙ্ক পাওনা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। [২] এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ভ্যাট আদায় সংক্রান্ত প্রায় ১০ হাজার মামলা রয়েছে। এসব মামলার বিপরীতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বছর বছর যে পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে, এর চাইতে বেশি মামলা যুক্ত হচ্ছে; ফলে আটকে থাকা রাজস্বের পরিমাণও বেড়ে চলেছে।
[৩] অন্যদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া ভ্যাট আটকে আছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ্ইে আটকে আছে ২৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
[৪] এনবিআর-এর তথ্যমতে, শুধু রাষ্ট্রীয় তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা)-এর কাছেই বকেয়া ভ্যাট আটকে আছে ২২ হাজার কোটি টাকা। গত ৮ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির সাথে বকেয়া ভ্যাটসহ রাজস্ব আদায়ের উপায় নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও কার্যকর কোনো ফল মেলেনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর একটি টিম গত অক্টোবরে ঢাকা সফরকালে এনবিআরের সঙ্গে বৈঠকে পেট্রোবাংলার কাছে বকেয়া থাকা বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের উপায় নিয়ে জানতে চেয়েছে। এমতাবস্থায়, সম্প্রতি ইস্যুটি নিয়ে এনবিআর সভা করেছে। কিন্তু পেট্রোবাংলা বলেছেÑ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে বরাদ্দ পাওয়া গেলে তারা ওই টাকা পরিশোধ করবে।
[৫] সূত্রমতে, পেট্রোবাংলা ছাড়াও সরকারি আরও ২৮টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের কাছে রাজস্ব বকেয়া পড়ে আছে। এ তালিকায় রয়েছেÑ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, যশোর পাসপোর্ট অফিস, বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডসহ সারাদেশের বেশ কয়েকটি পৌরসভাও রয়েছে এ তালিকায়।
[৬] সূত্রমতে, সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আটকে থাকালেও তা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। বরং নতুন নতুন মামলায় আটকে থাকা রাজস্বের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। তারপরও বকেয়া রাজস্ব আদায় এবং উচ্চ আদালতে মামলার সংখ্যা কমানোর জন্য জন্য এনবিআর কাজ করছে। ইতোমধ্যে কিছু মামলার রায় সরকারের পক্ষে এসেছে।
[৭] সংশ্লিষ্টদের মতে, মামলায় থাকা সব রাজস্বই যে এনবিআর পাবে, তা নয়। অতীতে দেখা গেছে, অনেক বড় অঙ্কের মামলায় এনবিআর এক টাকাও পায়নি; অর্থাৎ রায় এনবিআরের ?বিপক্ষে গেছে। অনেক সময় যৌক্তিক কারণ ছাড়া রাজস্ব ডিমান্ড করা হলে শেষে গিয়ে ওই মামলা টেকে না। তবে আদালতে মামলা নিয়ে যাওয়া ব্যক্তি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একটি অংশের উদ্দেশ্য থাকে মামলা করে সরকারের রাজস্ব যত বেশি সময় পর্যন্ত পারা যায়, ঝুলিয়ে রাখা। সব মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর জানা যাবে, এর মধ্যে প্রকৃত পক্ষে কী পরিমাণ রাজস্ব এনবিআর পাওনা হবে।
[৮] তাদের মতে, মামলা যাতে না হয়, সেজন্য এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগেরও দায়িত্ব রয়েছে। প্রতি বছর বাজেটে কিছু পরিবর্তন আসে। যে বিভাগের ওপর ট্যাক্স সংক্রান্ত পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে, এনবিআর-এর অফিসারদের উচিত, বাজেট শেষেই দ্রুত তাদেরকে বিষয়টি ইনফর্ম করা, বুঝিয়ে দেওয়া। কিন্তু এতে ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে মামলার সংখ্যা ও বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
[৯] এনবিআর সূত্রে জানা যায়, এদিকে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন চালুর পর সেখান থেকে ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে। আগে যেসব ব্যবসায় প্রতিমাসে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা ভ্যাট দিত, তারা এখন ইএফডি বসানোর পর মাসে ৫০ হাজার টাকা ভ্যাট দিচ্ছে। অন্যদিকে সম্প্রতি আমদানি প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। তবুও, গত পাঁচ মাসে ভ্যাট আদায়ে ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
[১০] জানা যায়, এখন পর্যন্ত ১৮ হাজার ইএফডি মেশিন বসানো হয়েছে; চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৬০ হাজার মেশিন বসানোর কথা রয়েছে। ইএফডি মেশিনগুলো এনবিআর সার্ভারের সাথে যুক্ত থাকে, যাকে ইএফডি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বলে। ফলে ইএফডি মেশিনে ইনপুট করা যেকোনো বিক্রয় তথ্য এনবিআর-এ চলে যায়। তাই বিক্রয়ের সময় ক্রেতার কাছ থেকে যে ভ্যাট আদায় করা হয়, তা বিক্রেতার এড়ানোর কোনো উপায় নেই। তবে বিক্রয় তথ্যের ইনপুট না থাকলে তা এনবিআরের জানার সুযোগ থাকে না; এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ এনবিআরের জন্য। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এনবিআর একটি কোম্পানি নিয়োগ করেছে, যারা প্রক্রিয়াটি তদারকি করবে।