শিল্প বিপ্লব সমাজে ক্ষতি বয়ে আনেনি
মুজিব রহমান
পাশ্চাত্য দর্শনের সাথে শিল্প বিপ্লবের বিরোধীতা করার মানুষের অভাব নেই— দক্ষিণ এশিয়ায়। তারা বলতে চায়, আধুনিকতা, পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শিল্প বিপ্লব— নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য তৈরি করেছে এবং মানুষের মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে। বাস্তবিক এমন অভিযোগগুলো ধুপে টিকে না। সময়ের সাথে তাল মেলাতে না পারা কিছু মানুষ এসবের বিরোধিতায় মগ্ন থেকে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। তারা পিছিয়ে যেতে যেতে দাবী করে বসে আদিম সাম্যবাদই ছিল মানবতার চূড়ান্ত শুদ্ধ রূপ। তারা অতীতের যাবতীয় অন্ধকার দিকগুলো গোপন করে কেবল অলীক সাম্যবাদই সামনে নিয়ে আসে যা বাস্তবে কখনোই ছিল না। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই শিল্প বিপ্লবের মধ্যেই বিকশিত হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ এবং ঘটেছে দুটি বিশ্বযুদ্ধ। এসময় দুটি পারমানবিক বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছিল।
১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার ছিল ১ম শিল্প বিপ্লবের চাবিকাঠী। কৃষি বিপ্লবের পরে ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ছিল এর ব্যপ্তি। এতে হাতের পরিবর্তে শুরু হয় মেশিনের ব্যবহার। যান্ত্রিক কারখানা স্থাপন করা হয়। শস্তায় বস্ত্র উৎপাদন হওয়ায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক শ্রেণির উত্থান ঘটে। এর রেশ ধরেই জন্ম নেয় সমাজতন্ত্রসহ বহু ভাবনার। আবার এ সময় উপনিবেশ তৈরিতে ইউরোপের ধনী দেশগুলো আরো সক্রিয় হয়ে উঠে। দুর্বল মানুষদের উপর কর্তৃত্ব করতে থাকে ইউরোপীয়ান দুর্বৃত্তরা। তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের আগেই উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ শেষ হয়। একেকটা শিল্প বিপ্লব গতি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এরপরেও প্রথম শিল্প বিপ্লবের ফলে যন্ত্রের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন শুরু হয় ব্যাপকভাবেই।
১৮৭০ সালে দ্বিতীয় শিল্প বিল্পবের মূল আবিষ্কার হল বিদ্যুৎ। এখন বিদ্যুৎহীন অবস্থা আবমরা কল্পনাও করতে পারি না। এ সময় রেলপথ, ইস্পাত উৎপাদন, ট্রেলিগ্রাম, পেট্রোলিয়াম চলে আসে। রেডিও, টেলিফোন, বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কার হলে বদলে যায় যোগাযোগের ধরন। আজ বিশ্ব ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে পড়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে কেউ বলছেন ডিজিটাল বিপ্লব আবার কেউ বলছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ। শিল্প কারখানায় স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। এসবের মূল লক্ষ্য কম জনবল দিয়ে অনেক বেশি পণ্য উৎপাদন করা। এসবই বিদ্যুৎ, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট নির্ভর। অনেকে একে স্মার্ট প্রযুক্তি বলছেন। বাংলাদেশও চাচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে যেতে। নির্বাচনে কিছু প্রার্থী স্মার্ট-জেলা করার ঘোষণাও দিচ্ছেন। রোবোটিক্স ও ন্যানো টেকনোলজির এখন জয় জয়াকার। এসব আমাদের জীবনকে সহজ ও সাবলিল করে তুলেছে। ২০১৫/১৬ সালে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণা প্রকাশিত হয়।
অনেকে অনেক নেতিবাচক বিষয় সামনে আনেন যার সাথে শিল্প বিপ্লবের কোন সম্পর্ক নেই। যেমন করোনা ভাইরাস সংক্রমণে এর সম্পর্ক তেমন নয়। এর আগেও বিশ্বজুড়ে ভাইরাসের মহামারী হয়েছে এবং কোটি কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। তবে শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে দ্রুতই করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের টীকা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া গিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে শিল্প বিপ্লবের আগে ও পরের বাংলাকে তুলনা করতে পারি। এখানে প্রথম শিল্প বিপ্লবের আগে থেকেই ইংরেজ শাসন শুরু হয়েছিল এবং তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের আগেও তা বহাল ছিল। সাম্রাজ্যবাদের কবলে থাকায় এখানকার সম্পদ ও শ্রমে ইংল্যান্ড ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের প্রভাবের সুফল কিন্তু আজ দক্ষিণ এশিয়া খুব ভালভাবেই কাজে লাগাচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মূল যে দুটি দিক- ডিজিটাল ও স্মার্ট তা দিয়েই রাজনীতিবিদগণ আশা দেখাচ্ছে জনগণকে।
দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশই রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টস শিল্পের উপর নির্ভরশীল। গার্মেন্টসতো প্রথম শিল্প বিপ্লবেরই বর্ধিত রূপ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সুফলগুলো সংযুক্ত হয়ে আজ বিশাল ইন্ডাস্ট্রিতে রূপ নিয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফলও এ শিল্পকে আরো এগিয়ে নিবে। আমাদের শ্রমিকরাও বিদেশে বিভিন্ন কল-কারখানায় কাজ করে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে প্রায় ২শ কোটি মানুষ। দেশগুলো মানুষের সুন্দর জীবন যাপনের যাবতীয় উপাদানগুলো তৈরি করতে পারে না। তাদের আমদানী করতেই হয়। যেমন বাংলাদেশ খাদ্যশস্য আমদানীতে পৃথিবীতে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টেস এর আয় না থাকলে ১৭ কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হতো না। খাদ্য উৎপাদনে শিল্প বিপ্লবের প্রভাবের কারণেই আজ বহুগুণ উৎপাদন বেড়েছে। নইলে ৮শ কোটি মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারতো না। অতীতের পৃথিবীতে নিয়মিত লেগে থাকতো দুর্ভিক্ষ ও দুর্দশা। মহামারীগুলো প্রতিনিয়তই হানা দিতো এবং বিপুল মানুষই মারা যেতো। যেমন দক্ষিণ এশিয়াতে কলেরা, ম্যালেরিয়া, বসন্তের মতো রোগে কোটি কোটি মানুষ মারা যেতো। পোলিওসহ বিভিন্ন রোগে শিশুরা মারা যেতো। একেকটা মহামারীতে এলাকার পর এলাকা বিরান হয়ে যেতো। মানুষের জন্ম হারও ছিল অনেক। কিন্তু বিপুল মৃত্যুহার মানুষের সংখ্যা বাড়তে দিতো না। পৃথিবীতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ না থাকার পরেও খ্রিস্টপূর্ব সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল খুবই সীমিত। প্রথম শিল্প বিপ্লবের পরেই চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও ব্যাপক উন্নতি ঘটে এবং জনসংখ্যার হার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এখন মানুষের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাওয়ায় উন্নত দেশে জনসংখ্যা আবারও কমে যাচ্ছে।
আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনষ্কতা, বিজ্ঞান চর্চা, পাশ্চাত্যের জীবন ও দর্শন এবং শিল্প বিপ্লবের বিরোধীতা করে নিজেদের পিছিয়ে রাখার প্রচেষ্টা নৈরাশ্যবাদ থেকেই এসেছে। নৈরাশ্যবাদীরা মনে করে আজকের পৃথিবীই সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। এরচেয়ে খারাপ কিছু আর হতে পারে না। ইউরোপের কিছু দার্শনিক ও সাহিত্যিকও নৈরাশ্যবাদকে উসকে দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। নৈরাশ্যবাদীরা মারাত্মকভাবেই কর্মহীন ও হতাশাগ্রস্থ এবং সুন্দর জীবনযাপনকে অর্থহীন মনে করে। এদের মধ্যে অনেক মাদকাসক্তও রয়েছেন। কোনভাবেই তারা জীবনকে অর্থময় করবেন না। অনেক আস্তিকও স্রষ্টার কাছে চেয়ে না পেতে পেতে নৈরাশ্যবাদী হয়ে উঠে। অল্প পড়াশোনা, জানাশোনার অভাব, অভিজ্ঞতার অভাব, দীর্ঘ অসুস্থতা, একাকীত্ব, সীমাহীন চাহিদা, মানসিক বিভিন্ন রোগও তাকে নৈরাশ্যবাদী করে ফেলতে পারে। আমার কয়েকজন মাদকসেবী বন্ধু রয়েছেন। তারা সীমাহীন নৈরাশ্যবাদী। এসব করে কী হবে?— এমন দর্শন নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিল। নিজের আত্মপ্রচারে ব্যপ্ত থাকে। তারা না জানি কি? কিন্তু যখনই অন্য মানুষের সান্নিধ্যে আসে তখন তারা নিজের দশা উপলব্ধি করে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে নৈরাশ্যবাদী হন এবং আবরো নেশার জগতে চলে যেতে তৎপর হন।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে স্বাগত জানানোর কোন বিকল্প নেই। কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো নাগরিকদের কল্যাণে কাজ করে যায়। ফলে কোন নাগরিকই অভূক্ত থাকে না। বিভিন্ন মানসিক রোগীকেও তারা কর্মক্ষম বানিয়ে তুলেন। কাজের মাধ্যমেও তারা জীবনকে উপভোগ করেন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার নাগরিকদের সক্ষম করে তোলা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে স্বাগত জানানোর জন্য।