পরিযায়ী পাখিদের বাঁচান
জিল্লুর রহমান : পরিযায়ী পাখি আমাদের অতিথি, প্রকৃতি ও পরিবেশের সেরা বন্ধু। হিমশীতল ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে উষ্ণ ও নিরাপদ পরিবেশ ও খাবারের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশে আসে। তারা একটি মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করে ও লোকেরা দলে দলে পাখি দেখতে যায়। বাংলাদেশে ২৮টি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জলপাখির সাইট রয়েছে। পরিযায়ী পাখিদের সবচেয়ে বড় আশ্রয় হলো দেশের বিভিন্ন জলাভূমি ও জলাশয়। শীত এলেই জলাশয়গুলো হয়ে ওঠে হাজারো পাখির কিচিরমিচির। প্রচণ্ড ঠান্ডা থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া, ইউরোপ, এশিয়ার কিছু অংশ ও হিমালয়ের আশেপাশের এলাকা থেকে এসব পাখি আমাদের দেশে আসতে শুরু করে। পরিযায়ী পাখি পরিবেশের উপকার করে ও ক্ষতিকারক পোকামাকড় খায়, কিন্তু পাখি শিকারীরা তাদের ধরে বিক্রি করে। তারা নিষ্ঠুর প্রতারণা ও ত্যাগের শিকার। পক্ষীবিদদের মতে, বাংলাদেশের পাখি প্রধানত দুই শ্রেণীর। আবাসিক ও অনাবাসিক পরিযায়ী পাখি অনাবাসী পাখি হিসেবে পরিচিত। দেশে আবাসিক ও অনাবাসীক পাখিসহ প্রায় ৬৫০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। তাদের মধ্যে, ৩৬০ প্রজাতির বাসিন্দা; অবশিষ্ট ৩০০ টি প্রজাতির মধ্যে ২৯০ টি শীত মৌসুমে আসে ও বাকি ১০ টি প্রজাতি দেশে থেকে যায়।
শীত এলেই দূর-দূরান্ত থেকে পরিযায়ী পাখি আসে। বাংলাদেশের খাল-বিল, হাওর, বাঁওড় বা জলাশয় পাখির আগমনে মুখরিত হয়ে ওঠে ও এই পরিযায়ী পাখিরা বাংলাদেশে এসে আমাদের দেশের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু কিছু দল আছে যারা এসব পরিযায়ী পাখি শিকার করে, যা কখনোই কাম্য নয়। বিশেষ করে মৌসুমী শিকারীরা পরিযায়ী পাখি শিকার করে খোলা বাজারে বিক্রি করে। পরিযায়ী পাখি যেমন দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ধন করে, তেমনি ভারসাম্য রক্ষায় তাদের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। এসব পাখি শিকারে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করা হয়। এই পরিযায়ী পাখিগুলো প্রায়শই গুলির গুলি, চোখের আলো, কেঁচো, কারেন্ট জাল, ফাঁদ ও বিষ টোপ দিয়ে শিকার করা হয়। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে পাখি শিকারের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু অসাধু লোক সামান্য লাভের লোভে পাখি শিকারে আসক্ত হয়ে পড়ে। বাজারে শীতকালীন পরিযায়ী পাখির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। চোরা শিকার একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইন, ১৯৭৪ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও সুরক্ষা আইন, ২০১২-এ শাস্তির বিধান রয়েছে। এতে বলা হয়েছে পাখি হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের কারাদণ্ড, এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। কেউ একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণ হবে। এছাড়া কোনো ব্যক্তি পরিযায়ী পাখির মাংস ও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ ও বিক্রি করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড ও ৩০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
উদ্বেগের বিষয় যে পরিযায়ী পাখির আগমন ও সংখ্যা দিন দিন কমছে। নির্বিচারে শিকারের কারণে অনেক প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পক্ষীবিদদের মতে, মানুষের নির্যাতনের কারণে ১৭ শতক থেকে প্রায় ১৩০ প্রজাতির পাখি চিরতরে হারিয়ে গেছে। পাখি ও পরিবেশ বিষয়ক এক গবেষণায় দেখা গেছে, নির্বিচারে পাখি নিধনের কারণে গত পাঁচ বছরে আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। নির্বিচারে গাছ কাটা, জলাভূমি ভরাট, বন উজাড় ও পরিবেশ দূষণের কারণে দেশিয় পাখির অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ও পাখিদের আগমনও আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। এসব কারণে দেশি ও পরিযায়ী পাখি রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। পাখি শিকারিদের ধরতে সচেতন নাগরিকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে আমরা পরাজিত হতে পারি না। পরিযায়ী পাখি শিকার রোধে বিদ্যমান আইন জোরদার করাও প্রয়োজন। স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতা বাড়ানোও জরুরি। চোরা শিকারীদের প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে হবে। পরিযায়ী পাখি ধরা ও খাওয়া বন্ধ করতে হবে। মো.জিল্লুর রহমানÑ ব্যাংকার ও কলামিস্ট। সূত্র : নিউএজ। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ