নারীদের জন্য নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করুন
তাসিন খান : বাংলাদেশে কর্মজীবী ??নারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার ছিল ৪২.৬৮%, যা ২০১৬ সালের ৩৬.৩% থেকে সামান্য বেশি। যদিও এই তথ্য অনুযায়ী, ৫০% এর বেশি নারী এখনও দেশের কর্মীবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত নয়। তবুও ক্রমবর্ধমান সংখ্যাটি আশাব্যঞ্জক। একটি সময় ছিল যখন কিছু পেশাকে নারীদের জন্য সীমাবদ্ধ বলে মনে করা হয়েছিল, কিন্তু মানুষ সেই পুরোনো চিন্তাধারা থেকে এগিয়েছে।
আমরা জানি, দেশের সব পোশাক শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। পোশাক শিল্প ছাড়াও নারীরা এখন হোটেল, রেস্তোরাঁ, যোগাযোগ, রিয়েল এস্টেট সেবা, টেলিযোগাযোগ, ব্যাংকিং, বীমা, প্রশাসন ও সাংবাদিকতার মতো বিভিন্ন চাহিদাপূর্ণ শিল্পে উপস্থিত রয়েছে। এছাড়াও বিদেশে কর্মরত নারীদের দেশের উপর উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে নারীদের অবদান বাড়ছে, কিন্তু তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনে আরও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। বিভিন্ন কারণে কর্মজীবী ??নারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আগে ঘর তবে পর এই কথা অনুযায়ী, কর্মজীবী ??নারীদের প্রতিবন্ধকতা শুরু হয় তাদের পরিবার থেকেই। নারীরা মাতৃত্ব ও সমস্ত গৃহস্থালির কাজগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো বহন করে, তাই তাদের খুব কমই পরিবার বা চাকরির জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকে। অনেক পরিস্থিতিতে, পরিবারের সদস্যরা সহযোগিতা করতে অস্বীকার করে ও মেনে নিতে অনিচ্ছুক যে মা তার সন্তানকে রেখে কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি সময় ব্যয় করবেন। ঘরে কর্মক্ষেত্রগুলোও নারীদের উভয় দায়িত্ব পালনে সহায়তা করে না, এইভাবে নারীরা উভয়ের মধ্যে বেছে নিতে বাধ্য হয়।
লিঙ্গ বৈষম্য থেকে শুরু করে কিছু মৌলিক সুবিধার অভাব পর্যন্ত নারীরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। তারা প্রায়শই প্রচুর কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক হয়রানির শিকার হন। ২০২০ সালে ন্যাশনাল গার্ল চাইল্ড অ্যাডভোকেসি ফোরাম, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, গার্লস অ্যাডভোকেসি অ্যালায়েন্সের অভিজ্ঞতা বিনিময় সভায় একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে যে ১৩৫ জন নারীর মধ্যে ১০০% জরিপে অংশগ্রহণকারীরা বলেছেন যে তারা তাদের কর্মক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। প্রায়শই তারা ইভ টিজিং, অশ্লীলতা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, ভয়ঙ্কর প্রস্তাব ও নোংরা বাক্যাংশ সহ বিভিন্ন ধরনের অপমানজনক পরিস্থিতির শিকার হন। একটি জরিপ অনুসারে, ৩২% এই লাঞ্ছিত নারীদের কোথাও অভিযোগ জানাতে পারে না।
এ অবস্থায় নারীদের নীরবে সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। এত কিছু মেনে নেওয়ার পরও কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি, বেতন ও ইনক্রিমেন্টের ক্ষেত্রে নারীরা প্রায়ই বৈষম্যের শিকার হন। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রে নারীরা কম বেতন পান। এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার সময়, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দেশে নারী শিক্ষার হার দিন দিন বাড়ছে, সব নারীকে যদি কর্মশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে অবিশ্বাস্য উন্নতি সাধিত হতে পারে। এমনকি সামাজিক পরিবেশও একটি অনুকূল রূপান্তর দেখতে পাবে। শ্রমশক্তিতে নারীদের উৎসাহিত ও টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার, সমাজ ও পরিবার সকলেরই কিছু সাধারণ ভূমিকা রয়েছে। একজন নারীকে কেবল একজন কর্মীই নয়, স্ত্রীর ভূমিকাও পালন করতে হবে ও মা তাই কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। কর্মজীবী ??নারীদের তাদের কর্মজীবন ও পারিবারিক প্রতিশ্রুতির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত মাতৃত্বকালীন ছুটি, নমনীয় কাজের সময়, সাইটে শিশু যত্ন ও শিশু যত্নের ভর্তুকির মতো সুবিধাগুলোর অ্যাক্সেস থাকা উচিত। সমান শ্রমের জন্য সমান বেতন, সেইসঙ্গে অগ্রগতি ও পদোন্নতির সুযোগ, একটি ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নমনীয় কাজের সময়সূচী, দূরবর্তী কাজের সুযোগ ও সুস্থতা কর্মসূচী প্রদানের মাধ্যমে নারীদের স্বাস্থ্য ও মঙ্গল উন্নত করা যেতে পারে। অফিস ও পাবলিক প্লেসগুলোতে পরিষ্কার বিশ্রামাগার, স্যানিটারি সরবরাহ ও প্রতিবন্ধী নারীদের অ্যাক্সেসযোগ্য সুবিধা থাকা উচিত। লিঙ্গ-নির্দিষ্ট নিয়ম বাস্তবায়ন করা ও কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি গড়ে তোলা যা অন্তর্ভুক্তি, বৈচিত্র্য ও লিঙ্গ সমতাকে সমর্থন করে কর্মজীবী ??নারীদের কল্যাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কর্মক্ষেত্রে নারীদের ক্ষমতায়ন ও সহায়তা করার জন্য সংস্থাগুলোর দ্বারা এই সুবিধাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। যদিও সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। উদাহরণস্বরূপ সরকার ২০০৯ সালে সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে একটি ‘হয়রানি বিরোধী কমিটি’ তৈরি করতে চায়। তবে প্রায় সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে এর অভাব রয়েছে। এই প্রোটোকল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কার্যকর করা উচিত। এটি নিশ্চিত করা অপরিহার্য। কর্মক্ষেত্র নারীদের জন্য বিপজ্জনক নয়। একজন নারী শুধু জাতীয় অর্থনীতির জন্যই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও অপরিহার্য। তাই সর্বত্র তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করুন। লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ