বাংলাদেশের বাইনারি রাজনীতি, ইতিহাসের গতিপথে আওয়ামী রেজিম ও আমাদের গণতন্ত্র
ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
পঁচাত্তরের পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত একটু একটু করে দুইটি পরস্পরবিরোধী ধারায় ভাগ হয়ে যায়। এটাকেই আমরা রাজনীতির বাইনারি ফেইজ বলতে পারি। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও আওয়ামী লীগের পতনের পর জিয়াউর রহমান একটি কমন প্ল্যাটফরম তৈরি করেছিলেন যেখানে আওয়ামী লীগ বিরোধী সকল গোষ্ঠীরই কদর ছিলো। চীনা বাম, মুসলীম লীগ, পাকিস্তানপন্থী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, মুক্তিযোদ্ধা, সফল পেশাজীবী, সফল ব্যবসায়ী, সাবেক সেনাকর্মকর্তা, সাবেক আমলা ইত্যাদি নানা ঘরানার একটা কমন প্ল্যাটফরম। যাদের একত্রিত হওয়ার মূল উদ্দীপনাটি ছিলো আওয়ামী বিরোধী জোট গঠন করা। এর সঙ্গে মিশিয়েছিলেন ধর্মের ইজম। কারণ আওয়ামী লীগ ছিলো সেক্যুলার। আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও নতুন বলয়ে ঢুকে পড়া ছিলো একটি সিগনিফিকেন্ট টার্ন। জিয়া যে দেশে ও দেশের বাইরে রাজনীতিতে একটা নতুন বার্তা দিতে চাইছেন, তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন শাহ আজিজুর রহমানের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে। একাত্তরের পর জাসদ প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও মুক্তিযুদ্ধ ও তার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে যে নতুন বিধান তৈরি করলেন তার যাত্রা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের উল্টোপথে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তিনি একই নীতিতে চললেন।
মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত স্রোতে হাঁটার বিষয়টা যে অতো সহজ ছিলোনা তা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে প্রমাণিত হয়। জিয়ার মৃত্যু আমাদের অনেক বার্তা দিয়েছিলো, কিন্তু জিয়ার অনুসারী রাজনীতিবিদরা সেই বার্তা গভীরভাবে গ্রহণ করেননি। বিএনপি নামের এই জোট জিয়াউর রহমান গঠন করেছিলেন ক্ষমতায় থেকে। দল গঠন করে তিনি ক্ষমতায় যাননি। বাংলাদেশে বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে সার্থক হয়ে ওঠে মূলত জিয়ার মৃত্যুর পর। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব, একদল তরুণ ক্যারিশমাটিক ছাত্রনেতা, জিয়ার আর্থিক সততার ন্যারেটিভ, কতিপয় সফল পেশাজীবী ও বাম রাজনীতিকের ইমেজ সব মিলিয়ে এটা ছিলো বিএনপির ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো সময়। একানব্বই ছিলো বিএনপির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় বছর। আমি মনে করি আশির দশকের পুরোটা সময় রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বিএনপি একটি পরিণত রাজনৈতি দলে উন্নীত হবার সুযোগ পেয়েছিলো। তার সুফল পায় ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়টায় বাংলাদেশ তার রাজনীতির বাইনারি সিচুয়েশন থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। প্রগতিশীল ও সেক্যুলার অনেক মানুষ তখন বিএনপিতে ছিলেন, আওয়ামী লীগেও ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগেও ছিলো বিএনপিতেও। সমর্থকরাও একইরকমভাবে ছিলেন। ৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিএনপির জামায়াত নির্ভরতা একটু একটু করে বাড়তে থাকে। গোলাম আজমকে দেশে ফিরিয়ে আনা, নাগরিকত্ব দেওয়া, শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে দেশদ্রোহী সাব্যস্ত করা ইত্যাদি আমরা দেখলাম। বিরোধীপক্ষ হিসেবে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র বুদ্ধিজীবীরা এই বিষয়টিকে দারুন কাজে লাগালো।
৯৫/৯৬ সালে বিএনপি বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েছিলো, একমঞ্চে বসেছিলো কিন্তু পরে সেটা তারা কন্টিনিউ করেনি। আওয়ামী লীগ তার মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকেই হাইলাইট করতে লাগলো। অন্যদিকে বিএনপি কাজে লাগালো ধর্ম। আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করতে জামায়াতকে আরো বেশি আঁকড়ে ধরলো। শুধু জামায়াতেই তার মন ভরলো না, আঁকড়ে ধরলো আমিনী, শায়খুল হাদিসের মতো ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলো জামায়াত, আমিনী ও শায়খুল হাদিসকে সঙ্গী করে। এসেই শুরু হলো পূর্বের অনেক হিসাব-নিকাশের জের। আওয়ামী লীগও ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করলো। দুই ধারায় দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে লাগলো। আওয়ামী লীগ যতো মুক্তিযুদ্ধে আশ্রয় নেয়, বিএনপি ততোই ধর্মে। এভাবে যেতে যেতে বিএনপি কাছে টানলো হরকাতুল জেহাদ, বাংলাভাই, শায়খ আব্দুর রহমান, আনসার বাংলা। আওয়ামী লীগ আরো বেশি ঝুঁকলো মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতিবাদ, শাহরিয়ার কবির, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদিতে। নব্বই দশকের শুরুতেও হাসিনা-খালেদায় দেখা হতো। ২০০১ এরপর তা আর কল্পনাতেও এলো না। বিএনপিতে ক্রমেই গুরুত্বহীন হতে লাগলেন মীর শওকত, অলি আহমেদ, তরিকুলরা। বহিস্কৃত হলেন বি. চৌধুরীর মতো নেতাও। ক্রমেই বেড়ে উঠলো তারেক বলয়। বিএনপির গর্ভে জন্ম নিলো নতুন আরেক বিএনপি। একানব্বইয়ের বিএনপির সঙ্গে এই বিএনপির বিস্তর ফারাক। ২০০৪ সালে এসে বাংলাদেশ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এক নতুন রূপ দেখলো। আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা। গ্রেনেড মেরে এক বিকেলেই বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন করে দেবার এক ভয়ঙ্কর খেলা আমরা দেখলাম।
বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত সেদিন থেকেই যেন এক নতুন চোরাগলিতে ঢুকে পড়লো। দুই দলের হাত মেলাবার আর কোনো পথ খোলা রইলো না। আরো বেশি দ্বন্দ্ব অবিশ্বাসের ভেতর দিয়ে চলতে লাগলো। এই পরিস্থিতেই এলো ওয়ান ইলেভেন। এরপর ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলো। ততোদিনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী লীগের আবেগীয় প্রচারণা তুঙ্গে। এর সঙ্গে যুক্ত হলো জামায়াত-শিবির ঘৃণা। যুক্ত হলো জাফর ইকবাল ফ্যাক্টর। আগের বিএনপি-জামায়াত রেজিমে ধর্মীয় মৌলবাদের ব্যাপক উত্থানের বিপরীতে দানা বাঁধলো প্রগতিশীলতা। এই সময়ে ইন্টারনেট ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লো। ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে গড়ে উঠলো একটা স্বতন্ত্র চিন্তার তরুন প্রজন্ম। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। আওয়ামী লীগও ২০০৮ এর নির্বাচনে ঘোষণা করেছিলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তাদের অন্যতম মেনিফেস্টো। এরকম একটা প্রেক্ষাপটেই ২০১৩ সালে দানা বাঁধলো শাহাবাগ আন্দোলন। অতঃপর শাহাবাগ আন্দোলন। ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের পর আমি এক লেখায় বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘসময়ের জন্য আরো বেশি করে বাইনারি সিচুয়েশনে ঢুকে গেলো। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতর দুটি বিপরীতমুখী ধারা একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলো। এক অমীমাংসিত যুদ্ধের সমাপনী পর্ব এটি। এই পর্ব কতোদিন চলবে আমরা জানি না।’ আমার আজ মনে হচ্ছে আমি সঠিকটাই বুঝেছিলাম। ওখান থেকেই মূলত আওয়ামী লীগের একজিট ডোর ক্লোজ হয়ে গেছে। এটা পয়েন্ট অব নো রিটার্ন।
আওয়ামী লীগ শাহবাগ আন্দোলন চেয়েছিলো আমার তা মনে হয়নি। তারা জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দিতে চায়নি। ভবিষ্যতে ক্ষমতা ছেড়ে রাজপথে আসতে হবেÑ আমার ধারণা এই দুশ্চিন্তা তাদের মাথাতে ছিলো। কিন্তু শাহবাগ আন্দোলন আওয়ামী লীগকে এমন এক সিচুয়েশনে নিয়ে গেছে তাদের আর পেছনে যাবার উপায় ছিলোনা। আওয়ামী লীগ সিচুয়েশন অনুযায়ী ডিসিশন পিক করেছে। শাহবাগ আন্দোলনে বিএনপি চুপ থাকলেও সমস্যা হতো না। কিন্তু তারা ইনিয়ে বিনিয়ে পক্ষ নিলো যুদ্ধাপরাধীদের। আশির দশকে যে বিএনপি ছিলো তরুণদের পছন্দের দল, ২০১৩ সালে সেই বিএনপি শাহবাগের তরুণ আন্দোলনকারীদের নাম দিলো ‘নষ্ট ছেলে’! এই সময়ে আমরা দেখেছি, বিএনপি তার পুরনো অবস্থানে আরো বেশি দৃঢ় হয়েছে। ইসলামপন্থীদের সঙ্গে তাদের সখ্যতা আরো নতুন নতুন মাত্রায় বাড়িয়ে নিয়েছে। বিএনপির গর্ভে জন্ম নিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। যারা ৫ মে ঢাকা দখল করতে এসেছিলো। জামায়াত তবু পলিটিক্যালি ম্যাচিউর, কিন্তু হেফাজতে ইসলাম পুরোই তালেবানের বাংলাদেশি ভার্সন। এরপর আমরা দেখলাম হেফাজত বিএনপির ডামি হয়ে, বাংলাদেশে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে আটবছর আওয়ামী লীগকে অস্থির করে তুললো প্রধান বিরোধী শক্তি হয়ে। বিএনপি ২০০১ সালে নিজেদের বিলীন করলো জামায়াতে, ২০১৩ সালে করলো হেফাজতে। বিএনপি এরপর আর নিজেদের খুঁজে পেলো না। আওয়ামী লীগও বসে রইলোনা। হামলা, মামলা সব রকমভাবেই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষের উপর রোলার চালালো। পার্থক্য একটাইÑ সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করেনি বা প্রকাশ্যে সমাবেশে গুলি করে মেরে ফেলেনি। ওই যে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন। আওয়ামী লীগের পথ এরপর একটাই। টিকে থাকা। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের জন্য বহিঃর্বিশ্বের চাপ ছাড়া আর কোনো চাপ রইলো না।