রেমিট্যান্স বৃদ্ধির জন্য কর্মীদের দক্ষতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
একেএম আতিকুর রহমান
কিছু স্থানীয় দৈনিক ২০২৩ সালে দেশের রেমিট্যান্স পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কেউ কেউ রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে বাড়তি প্রণোদনা প্রদানসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও রেমিট্যান্স আগের বছরের তুলনায় বাড়বে কিনা সন্দেহ প্রকাশ করেছে, আবার কেউ কেউ উল্লেখ করেছে যে রেমিট্যান্স বেড়েছে সামান্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স হিসেবে ২১.৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পেয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২.৫৪% বেশি। আমরা যদি রেমিটেন্স ও বিগত কয়েক বছরের অভিবাসী শ্রমিকদের সংখ্যা বিশ্লেষণ করি তবে আমরা একটি পরিষ্কার চিত্র পাব যা আমাদের সামগ্রিক পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করতে পারে। ২০১৯ সালে, বাংলাদেশ ৭ লাখ কর্মী পাঠিয়েছে ও ১৮.৩৩ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পেয়েছে, ২০২০ সালে ২ লাখেরও বেশি কর্মী বিদেশে পাঠানো হয়েছে ও ২১.৭৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে, ২০২১ সালে ৬ লাখেরও বেশি কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে ও ২২.০৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে। ২০২২ সালে প্রাপ্ত রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ২১.২৯ বিলিয়ন ডলার ও শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১১ লাখের বেশি, ২০২৩ সালে ২১.৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স হিসাবে গৃহীত হয়েছিল যখন রেকর্ড সংখ্যক ১২ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠানো হয়েছিল।
আমরা যদি ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ্য করি, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে ২০১৯ ও ২০২২ সালের তুলনায় কম সংখ্যক কর্মী পাঠানো সত্ত্বেও দেশটি ২০২০ সালে বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পেয়েছে। আবার ২০২১ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে দেশটি কম রেমিট্যান্স পেয়েছে, যদিও শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২০২৩ সালে বিদেশে ২০২১ সালে যে কর্মী পাঠানো হয়েছিল তার দ্বিগুণ ছিল। এ প্রসঙ্গে আমরা প্রতিবেশী ভারতের উদাহরণ দিতে পারি। ২০২২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম রেমিট্যান্স প্রাপক দেশ ও ভারত শীর্ষে ছিল। ভারত ২০২১ ও ২০২২ সালে যথাক্রমে ৮ লক্ষ ও ১৩ লক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠিয়ে ৮৬ বিলিয়ন ডলার ও ১১১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পেয়েছে। বলা বাহুল্য যদিও দুই দেশ থেকে বার্ষিক কর্মী পাঠানোর সংখ্যার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না, বাংলাদেশের বার্ষিক রেমিট্যান্স ছিল ভারতের এক-পঞ্চমাংশ।
প্রকৃতপক্ষে অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে আনুপাতিক হারে রেমিট্যান্স বাড়ে না। মূলত রেমিট্যান্স আসে বিদেশে কর্মরত সকল প্রবাসী নাগরিকদের কাছ থেকে যা স্থায়ী ও অস্থায়ী উভয় প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করে। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট বছরের জন্য রেমিট্যান্স বৃদ্ধি সেই বছরের শ্রমিক সংখ্যার উপর নির্ভর করে না। এক্ষেত্রে রেমিট্যান্সের পরিমাণ নির্ভর করে এক বছরে বিদেশে কর্মরত মোট বাংলাদেশির সংখ্যার ওপর। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দক্ষ কর্মী পাঠানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ যত বেশি দক্ষ কর্মী পাঠাতে পারব, তত বেশি রেমিট্যান্স পাব। এ ছাড়া মানি লন্ডারিং রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, হুন্ডির মতো অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করতে হবে ও একই সঙ্গে বৈধ মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থাকে আরও সহজ, আকর্ষক ও উৎসাহিত করতে হবে।
বিগত ১৪ বছরে বিদেশে পাঠানো আমাদের দক্ষ শ্রেণীর কর্মীদের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে অদক্ষ বা স্বল্প-দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা মোটের ৭০% এর বেশি, দক্ষ শ্রেণী ২২-২৫% এর মধ্যে, আধা-দক্ষ শ্রেণী নীচে ৫% ও পেশাদার শ্রেণীর শতকরা তুলনায় অনেক কম। দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ৭০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারলে বাংলাদেশের বার্ষিক রেমিট্যান্স বহুগুণ বেড়ে যাবে। দেশের বিদ্যমান অবকাঠামো ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া বিবেচনায় রাতারাতি এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এই বিষয়ে একটি ৫ থেকে ১০ বছরের পরিকল্পনা নেওয়া উচিত, যদি আমরা এটির জন্য সত্যিই সিরিয়াস হই। বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর কাজে নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এই ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে।
‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান’ ইস্যুতে, এর নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক চাহিদা বিবেচনা করে আমরা বাণিজ্য-ভিত্তিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা প্রসারিত করব। আমরা বিদেশে কর্মীদের আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রাখব। বিদেশে নারী শ্রমিকদের ন্যায্য আচরণ সুরক্ষার জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নিঃসন্দেহে রেমিটেন্স বাড়াতে আমাদের জন্য দক্ষ কর্মী পাঠানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু কর্মী প্রেরণের বিদ্যমান ব্যবস্থা শ্রমিকদের যথাযথ সুরক্ষা ও ন্যূনতম অভিবাসন-খরচের গ্যারান্টি দেয় না, তাই এই বিষয়ে দলের অবস্থান ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা তার ইশতেহারে প্রতিফলিত হলে এটি আরও জনগণের পক্ষে হতে পারে।
এই ক্ষেত্রে একটি ‘অভিবাসী শ্রমিক-বান্ধব’ নিয়োগ ব্যবস্থা সেই দিকগুলোকে উন্নত করতে কার্যকর হতে পারে। বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে আমাদের সংখ্যাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তবে অগ্রাধিকার দিতে হবে দক্ষ কর্মী পাঠানোর ওপর। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোকে আমাদের দক্ষ কর্মীদের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ খুঁজে বের করার নির্দেশ দিতে হবে। তাছাড়া যেসব দেশে বিদেশি দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে তাদের সঙ্গে কার্যকর ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি দেশের রেমিট্যান্স বাড়াতে নতুন সরকারকে অবশ্যই একটি সুপরিকল্পিত ‘স্মার্ট মাইগ্রেশন’ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব।
সূত্র : ডেইলি সান। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ