গরুর মাংসের দাম বেড়ে ৬৫০ থেকে ৭৪০ : দায় কার?
কাজী এম মুর্শেদ
কয়েকদিন আগে গরুর মাংসের দাম নিয়ে লিখেছিলাম। খুব সম্প্রতি বাজারে গেলাম, দাম বেড়ে গেছে। ৬৫০ টাকার মাংস ৭৪০ টাকা। জানালো, নির্বাচন উপলক্ষ্যে দাম কম রাখার কথা ছিলো। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর সেটা বলেছিলো। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের কাজ বাজারে পণ্যের দাম ও মান দেখা। দাম দেখা মানে কেউ অতিরিক্ত মুনাফা করলে সেটা দেখাটাই কাজ। মান কতোটা বোঝে জানা নেই, তবে আগেও দেখেছিলাম তাদের কাজ হলো বিভিন্ন দোকানে গিয়ে কতো দামে কেনা কতো দামে বেচা সেটা দেখে পছন্দ না হলে জরিমানা করা। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর যে কাজটা করতে পারে তাহলো কেউ অতিরিক্ত মুনাফা করলে বা মানসম্মত পণ্য না হলে সেটার জন্য জরিমানা, কেউ যেন মনোপলি বা ডুয়োপলি না করে সেটা দেখা, কিন্তু কে কতো মুনাফা করবে সেটা সরাসরি ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সেটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যদি দেখে বিক্রেতারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তখন নিজ উদ্যোগে টিসিবি মারফত আমদানি করে বা কিনে তা কম দামে বাজারে ছাড়া। সেক্ষেত্রে সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গুদাম আছে, লাইসেন্স দেওয়া কোল্ড স্টোরেজ আছে। কিন্তু এটা ক্যাপিটালিস্ট বাজার ব্যবস্থা, বিক্রেতা দাম ঠিক করবে, ক্রেতা পারলে কিনবে না হলে কিনবে না। একইসঙ্গে ক্রেতার কেনা বা না কেনা তাদের ইচ্ছা, যদি না কেনে তখন বিক্রেতা দাম কমাতে বাধ্য হবে।
এই অধিদপ্তরকে আরো ক্ষমতায়িত করেন, সমস্যা নেই, কিন্তু পণ্যের দাম দুই রকমের হয়, এমআরপি বা ম্যাক্সিমাম রিটেইল প্রাইস এবং এসআরপি বা সাজেস্টেড রিটেইল প্রাইস। দুই দামের মাধ্যমেই যা বলা হয়, এই দামের মধ্যে খুচরা বিক্রেতার দাম ধরা আছে। কোনো বিক্রেতা যদি এই দামের উপর ডিসকাউন্ট দিয়ে কম দামে বেঁচতে চায়, সেটা তার অধিকার। অনেক ওষুধের দোকান ৭% ডিসকাউন্ট দেয়, অনেকে দেয় না, কিন্তু নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্যের উপর বেচার অধিকার নেই। সেখানে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু কম দামে বেঁচলে পারে না। আমাদের দেশে গরুর মাংসের দাম বেশি, এই উপমহাদেশের যেকোনো দেশ থেকে বেশি। দাম বেশি হওয়ায় অনেকে মাংস কেনা বন্ধ করার পর কেউ কেউ ৮০০ টাকার মাংস ৬০০ টাকার নীচে বিক্রি শুরু করলে তাদের বিক্রি বেড়ে যায়, ক্রেতা বাড়তে থাকে। সেই সময় এই অধিদপ্তর হস্তক্ষেপ করে মূল্য নির্ধারণ করে ৬৫০ টাকা কেজি, যা নির্বাচন পর্যন্ত চলবে, এরপর আবার দাম বাড়ানো যাবে।
গরুর মাংসের কেজি এখন বাড়ছে, যেটাকে বলছেÑ তারা ক্ষতি úূরণ করছে। দোকানে দাম বাড়ছে, সুপার স্টোরে বাড়ছে, কিন্তু যারা খামারি, তারা একই দামে গরু বিক্রি করছেন। অধিদপ্তরের কাজ কি এই সুপারস্টোর আর কসাইদের লাভ নিশ্চিত করা? জনগণের জন্য কেনা আবার কঠিন হয়ে যাচ্ছে, এই বাড়তি দাম যদি খামারি পেতো, সেক্ষেত্রে একটা কারণ ছিলো।
তারা কিন্তু পাচ্ছে না। এটা আমার কথা নয়, পত্রিকায় পড়লাম খামারি গরুর দাম বাড়ায়নি, তাহলে বাজারে বাড়লো কীভাবে? ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের কাজ যদি ভোক্তা বা উৎপাদনকারীর লাভ না দেখে মধ্যসত্ত্বভোগীর লাভ দেখা হয়, তাহলে এমন অধিদপ্তরের দরকার কী?
আগের বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ী, বিশেষত সিন্ডিকেটের সেবা করে গেছেন, টানা তিনবছর সেবা করে গেছেন, নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী শুরুতেই বেশ হুঙ্কার দিচ্ছেন, তিনি কোনো সিন্ডিকেট দাঁড়াতে দেবেন না। অপেক্ষা করেন, উনিও এই সিন্ডিকেটের হাতে বন্দী হবেন। হতেই হবে। বাণিজ্যমন্ত্রণালয় বা ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর বা টিসিবি, সবই চলে কিছু অলিগার্কি বা সিন্ডিকেটের ইশারায়। সরকারি দলের নির্বাচনের মেনিফেস্টোর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ছিলো ভোক্তার জন্য পণ্যের দাম সহনশীল করা। অপেক্ষা করছি, কোন অলিগার্কি বা সিন্ডিকেটকে হাত দেবার সাহস করতে পারে। কারা এর অংশ কমবেশি সবাই জানেন, তাদের পণ্য বর্জন করা না করায় এদের কিছু আসে যায় না, তাদের সরকারের উপর যেই প্রভাব, চাইলেই যে কোনো সময় সব ব্যবসা বন্ধ করতে পারে। দুর্ভিক্ষ মানে খাবারের অভাব না, বরং খাদ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের হাতে খাবার কেনার টাকা নেই। এর জন্য বিদেশি কোনো শক্তির হাত লাগে না, দেশিয় সিন্ডিকেটই যথেষ্ট। সরকার যে আভাস দিচ্ছে, তাতে বিদেশি শক্তির উপর দোষ চাপানোর কথা থাকলেও অপেক্ষা করেন। এর শুরু হলে তা দেশিয় সিন্ডিকেটকে না সামলাতে পারার ব্যর্থতাই একমাত্র কারণ হবে। লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক