আমাদের কৃষকদের জন্য একটি দিন উদযাপন করার সময় এসেছে
সমীরন বিশ্বাস : বাংলাদেশ একটি প্রধান কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কৃষির অবদান অনেক। কৃষকরা দিনরাত পরিশ্রম করে আমাদের মুখে খাবার দেয়। ঘাম ঝরিয়ে ফসল ফলান। একটি মাত্র সবজি বা ফসল তাদের কাছে শিশুর মতো। তাদের কারণে আমরা ভালো-মন্দ খেতে পারি। কিন্তু আমাদের খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক সময় তাদের হাতে দুই মুঠো ভাত থাকে। তবে তারা তাদের কাজ চালিয়ে যায়। আজ সেই কৃষকদের ধন্যবাদ জানাতে একটি দিবস পালন করা দেশের সার্বিক দায়িত্ব। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন তিনগুণ, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচগুণ ও ভুট্টার উৎপাদন দশগুণ বেড়েছে। এমনকি দুই শতাব্দী আগেও দেশের অর্ধেক অংশে এক ফসল ও বাকি অংশে দুই ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হয়। পরিশ্রমী কৃষক ও কৃষিবিদদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ সাফল্য সম্ভব হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে দুই টন ধান উৎপাদিত হয়। এখন উৎপাদন হেক্টরপ্রতি চার টনের বেশি। হিসাব করলে তা ছয় টন ও এভাবে প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে। দেশের এই সমৃদ্ধির পেছনে কৃষকদের অবদান অনস্বীকার্য।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষকদের জন্য একটি দিন রয়েছে। মূলত এই দিনে দেশ ও জাতির প্রতি কৃষকের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে এমন কোনো দিন নেই। জাতীয় কৃষক দিবস বা কৃষাণ দিবস ২৩ ডিসেম্বর ভারতে পালিত হয়। এই দিনটি ১৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানে, আফগানিস্তানে ২২ মার্চ, ঘানা ডিসেম্বরের প্রথম শুক্রবার, দক্ষিণ কোরিয়া ১১ নভেম্বর, ভিয়েতনাম ১৪ অক্টোবর ও জাম্বিয়ায় পালিত হয় আগস্টের প্রথম সোমবার। আমেরিকাতে, জাতীয় কৃষক দিবস প্রতি বছর ১২ অক্টোবর পালিত হয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে চীন, আমেরিকা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জাতীয় কৃষক দিবস পালিত হয়। মূলত এই দিনে দেশ ও জাতির প্রতি কৃষকের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে অবশ্য পহেলা অগ্রহায়ণ জাতীয় কৃষি দিবস ও ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষক দিবস উদযাপন করা হয়। প্রথম অগ্রহায়ণ জাতীয় কৃষি দিবস ২০০৮ সালে নবান্নর সঙ্গে একত্রে ঘোষণা করা হয়েছিলো। কিন্তু এটাও সারাদেশে ব্যাপকভাবে পালিত হয় না। কৃষকরা দেশের মেরুদণ্ড। তারা ফসল ফলাতে না পারলে দেশ আজ এই পর্যায়ে পেতো না। অন্য কাজের পরিবর্তে ফসল ফলাতে হতো। যারা এতো কম অর্থের জন্য আমাদের এতো বড়, সবচেয়ে মূল্যবান পরিষেবা প্রদান করে তারা প্রায়শই অবহেলিত হয়। একজন কৃষক বা কৃষক বাড়ির ছেলে মেয়েরা আর পাঁচটি আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের মতো বেড়ে ওঠে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সংসার চলে কোনো উপায় ছাড়াই। এই ফসলের চাষ বা চাষীর শ্রমের পেছনে রয়েছে অনেক কষ্ট, অনেক সংগ্রাম, যা জানা যায় না। পর্দার পেছনের এই নায়কদের ধন্যবাদ জানানোর এখনই সময়।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষকদের পরিশ্রমে আমরা খাদ্য পাই। আমাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় আমাদের অর্থনীতি প্রধানত কৃষির উপর নির্ভরশীল। বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজে নিয়োজিত। তাই জাতীয় অর্থনীতির উন্নতির জন্য কৃষকদেরকে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনের পদ্ধতি শেখাতে হবে। কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের উচিত সহজ শর্তে ভর্তুকি ও ঋণ দেওয়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন কৃষক খুবই দরিদ্র। অধিকাংশ কৃষকের নিজস্ব জমি নেই। তাই সে অন্যের জমি চাষ করে। সে তার মৌলিক চাহিদা পূরণ করেই বেঁচে থাকে। ফসল রোপণ বা বপনের জন্য জমি প্রস্তুত করতে তিনি খুব পরিশ্রম করেন। আমরা কৃষকদের রোপণ করা ফসল ফলিয়ে ও সেই ফসল সংগ্রহ করে আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য পাই। তারা ফসলের ক্ষেতে কঠোর পরিশ্রম করে, বাম্পার ফসল উৎপাদন করে যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়তা করে। আমরা জানি বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। আমাদের অর্থনীতিও অনেকাংশে এর ওপর নির্ভরশীল। তাই জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে সরকারকে কৃষি ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের সহায়তা করতে হবে। মান্ধাতার লাঙলের পরিবর্তে ট্রাক্টর ব্যবহারে তাদের উৎসাহিত করা উচিত। তাদেরকে আধুনিক কৃষি পদ্ধতি শেখাতে হবে। এভাবে কৃষকদের সুন্দর জীবন বিকশিত হতে পারে।
একজন কৃষক হলো এমন একজন ব্যক্তি যিনি জমি চাষ করেন ও ফসল ফলান। তিনি আমাদের সমাজের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সাধারণত সে গ্রামেই থাকে। তার ঘর ঢেউতোলা লোহা বা খড় দিয়ে তৈরি। একজন আদর্শ কৃষক খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেন। ঘাম ঝরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন। সে খুব সকালে উঠে একটু নাস্তা করে। সে তার কাঠের লাঙ্গল আর এক জোড়া বলদ নিয়ে মাঠে যায়। তিনি সাধারণ হাতে তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে জমি চাষ ও প্রস্তুত করেন। মাঝে মাঝে সে এতোটাই ব্যস্ত থাকে যে দুপুরের খাবারের জন্য তার বাড়িতে যাওয়ার সময় নেই। তার জীবনে সুখ-দুঃখ দুটোই আছে। ফলন ভালো হলে তিনি খুশি। কিন্তু খরা, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ে তার ফসল বিনষ্ট হলে তিনি কষ্ট পান। একজন কৃষক কঠোর পরিশ্রম করলেও তার পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না। সে দিনে আনে দিনে খায়। তিনিও নানা রোগে ভুগছেন। তিনি সহজ ঋণের সুবিধা গ্রহণ করে একটি পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবহার করে তার অবস্থার উন্নতি করতে পারেন। তাকে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। আমাদের সমাজে একজন কৃষককে নিচু জাতের হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একজন আদর্শ কৃষকই দেশের সম্পদ। এটি দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। আমাদের উচিত সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তাদের সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি করা। কৃষিপ্রধান এই দেশে কৃষকদের জন্য একটি দিবস পালন করা দেশের সার্বিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের ১৮ কোটি মানুষকে খাওয়ানো কোনো ছোট কীর্তি নয়। যারা এই ক্ষুধা মেটাবে তাদের সম্মান করলেই জাতি সমৃদ্ধ হবে।
লেখক : কৃষিবিদ। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ