ব্যাংকের প্রতি অনাস্থা তৈরি হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই : গভর্নর
মো. আখতারুজ্জামান : [১] ব্যাংকের প্রতি অনাস্থা তৈরি হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। বিগত ৫২ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
[২] গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান ভবনের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে আনুষ্ঠানিকভাবে মুদ্রানীতি ঘোষণার অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন।
[৩] ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখার ক্ষেত্রে মানুষের অনাস্থা তৈরি হয়েছে কি না, সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনাস্থা তৈরি হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি। ভবিষ্যতেও কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবে, এমন সম্ভাবনাও নেই।
[৪] চট্টগ্রামভিত্তিক একটি গ্রুপের হাতে থাকা পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের সংকটময় পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার চেয়ার ছাড়ার কোনো ভয় নাই। আমি কাউকে ভয় পাই না। এসব ভয়-টয় দেখাইয়া লাভ নাই। আমি সচিব ছিলাম, এক বছরের বেশি সময় চাকরি ছিল। এখন গভর্নর হয়েছি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে। আমি চাইলে চাকরি ছেড়ে দিতে পারবো, আবার সরকার চাইলেও আমাকে সরিয়ে দিতে পারে। তবে চেয়ার হারানোর ভয় নাই, কোনো হুমকিও নাই। ভয় দেখাইয়াও লাভ নাই।
[৫] বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোর কাঠামোতে সমস্যা ছিল। সেখানে তারল্য সংকট হয়েছে অন্য কারণে, তাদের সুকুক বন্ড রয়েছে টোটাল ইসলামী ব্যাংকের দুই শতাংশ। অন্য ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট ছিল। তবে তাদের বন্ডে বিনিয়োগ থাকায় তারা টাকা পেয়েছে।
[৬] আর্থিক খাতের দুর্বলতার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা আগেই দুর্বল ব্যাংকগুলো চিহ্নিত করেছিলাম। দেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি, হবেও না। তবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে। তারা খারাপের দিকে যায়নি, আর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবে।
[৭] গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্বল ব্যাংক হিসেবে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছিল, বর্তমানে তাদের অবস্থা কী, জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, যেসব ব্যাংক দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে সেগুলো আর দুর্বলতার দিকে ফিরে যায়নি।
[৮] মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দেওয়ার চলমান উদ্যোগের মধ্যে বাজারে অর্থের জোগান আরও কমাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক; এর অংশ হিসেবে নীতি সুদহার আরও এক দফা বাড়িয়ে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য সতর্ক ও সঙ্কুলানমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এ পরিবর্তনের ফলে এক দিন মেয়াদী রেপোর (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদ হার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে ৮ শতাংশ হয়েছে।
[৯] এবার বিশেষ রেপো সুদহারে (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি-এসএলএফ) নীতি সুদহার করিডোরের উর্ধ্বসীমা ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে, বর্তমানে তা ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
[১০] সুদহার করিডোরের নিম্নসীমা রিভার্স রোপো সুদহার (স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি-এসডিএফ) বিদ্যমান ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাড়ে ছয় শতাংশ করা হয়েছে।
[১১] নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্ন সীমার মধ্যে ব্যবধান ২০০ শতাংশ পয়েন্ট থেকে কমিয়ে ১৫০ শতাংশ পয়েন্টে নামিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ নীতি সুদহার ৮ শতাংশের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১৫০ বেসিস পয়েন্ট যোগ করে এসএলএফ সুদহার ও নিচে ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বিয়োগ করে এসডিএফ সুদহার নির্ধারণ করা হবে।
[১২] কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমন, বিনিময় হারের চাপ নিয়ন্ত্রণ, সরকারের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রয়াজনীয় অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে মুদ্রানীতিতে। তবে ৪ শতাংশের ব্যাংক রেটে পরিবর্তন আনা হয়নি।
[১৩] ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধ অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে চাহিদা কমাতে ও দাম নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক নীতি ধরে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই হিসাবে, ঋণের সুদ বাড়াতে পলিসি রেট বা রেপো রেট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়। এর আগে, গত জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ করে, যা জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে।
[১৪] এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ছয় মাসের মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল (স্মার্ট) চালু করে, এজন্য আগের ৯ শতাংশ সুদ হারের সীমা তুলে নেওয়া হয়। এরপর থেকে বাজারে অতিরিক্ত তারল্য কমে যাওয়ায় সুদের হার বাড়তে থাকে।
[১৫] দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ। গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে ও আগামী জুনের মধ্যে তা ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
[১৬] এসময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নররা, বিএফআইইউ’র প্রধান কর্মকর্তা, চিফ ইকোনোমিস্ট, গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও সহকারী মুখপাত্ররা।
[১৭] এর ২০২২-এর জুলাইয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর তৃতীয় মুদ্রানীতি নিয়ে আসছেন আসা আব্দুর রউফ। যা প্রণয়নের ক্ষেত্রে এবার সচরাচর পদ্ধতির বাইরে গিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে ভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে।