আজ রাম মন্দির উদ্বোধন করবেন নরেন্দ্র মোদী
বিশ্বজিৎ দত্ত : [১] ভারতের ইতিহাসে পাঁচটি সবচেয়ে মোড়-ঘোরানো ঘটনার মধ্যে সম্ভবত অন্যতম হতে চলেছে অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধন। যার প্রধান ঋত্বিক মোদী স্বয়ং। কালো গ্রানাইট পাথরে তৈরি ৫১ ইঞ্চির যে মূর্তিতে তিনি প্রাণপ্রতিষ্ঠা করবেন।
[২] ভারতে একের পর এক রাজ্য অর্ধদিবস ছুটি ঘোষণা করছে। মুকেশ অম্বানী তাঁর সমস্ত দফতরে পুরো দিনটাই ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। অযোধ্যা জুড়ে ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গের তালে তালে লোক নাচছে। ফুলেল আবহে গদগদ করছে ভক্তি। ১২০০ কিলোর অতিকায় লাড্ডু বানানো হচ্ছে। এসেছে ৪০০ কিলো ওজনের তালা। মনুমেন্টের সাইজের ধূপকাঠি আসছে ট্রাকে চেপে।
[৩] শুধু কি ভারত রামপত্নি সীতার জন্মভ’মি নেপাল থেকে আসছে সোনার অলংকার, কাপড়, ফলাদি, ৫০০ জোড়া রুপার জুতো। মারিসাসে, সুরিনামে রাষ্ট্রিয় একদিনের ছুটি ঘোষণা। আফগানিস্থান থেকে আসছে নদীর জল।
[৪] অযোধ্যা জুড়ে ভীমনাদ উঠছে জয় শ্রীরাম, জয় সিয়ারাম বলে। রামমন্দিরের ডিজাইনের আমেরিকান ওয়ালনাট কাঠের তিনতলা বাক্সে বন্দি হয়ে পৃথিবীর অন্যতম দামি রামায়ণ জাপান থেকে আমদানিকৃত হয়ে এসেছে অযোধ্যায়। অর্গানিক কালিতে ছাপা। দাম ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। বড় বড় প্রেক্ষাগৃহে টিকিট কেটে রামমন্দিরের উদ্বোধন দেখানোর বন্দোবস্ত হয়েছে।
[৫] রামমন্দির দর্শন মার্গ ধরে দু’পাশে একের পর এক মন্দির। রাম-সীতার মন্দির। রাধা-কৃষ্ণের মন্দির। শেষতম তল্লাশির পর একটা শুঁড়িপথ। লম্বা খাঁচার মতো। দু’পাশে জাল। মাথার উপর জাল। খানিক এগিয়ে সেই জালের ডান দিকে কর্মভূমি। মন্দিরের ভিত তৈরি হয়ে গিয়েছে। ২.৭৭ একর জমি। যার পুরোটা জুড়ে মাথা তুলেছে রামমন্দির। আশপাশের আরও অনেক জমি নিয়ে পুরো এলাকাটা অনেক, অনেক বড়। ১০৮ একর। ৩০৩ বিঘা।
খাঁচার ভিতর দিয়ে খানিক এগিয়ে রামলালার মন্দির। কৌণিক ছাদ। দেওয়ালে কাচ-বসানো জানালা। মন্দিরের বাইরের চত্বরটা ঢাকা ছিল টকটকে লাল কার্পেটে। ভিতরে রামলালার মূর্তি। তীব্র আলোয় ঝলমল করছিল। পটভূমিকায় ঝকমকে জরির কাপড়। মূর্তির আশপাশে বাড়তি একটা জেল্লা। একটা ছটা। একটা ঐশী বিভ্রম।
[৬] জন ডেনভারের কান্ট্রি রোডস’র অনুকরণে অযোধ্যা রোড্?স’ গান বেঁধে এক্স’-এ পোস্ট করা হচ্ছে। যার লাইন বলছে, অযোধ্যা রোডস, টেক মি হোম, টু হিজ অ্যাবোড, হোয়্যার আই বিলং (ভাবা যায়)। অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াত বলছেন, অযোধ্যা ধাম হল ভ্যাটিক্যান সিটির মতো। রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার পরেই দেশে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রৌঢ জ্যাকি শ্রফ মুম্বইয়ে ক্যামেরার সামনে মন্দির ঝাঁটাচ্ছেন। অমিত শাহ বলছেন, সাড়ে পাঁচশো বছর অসম্মান সহ্য করার পরে ভগবান রামকে তার নিজের ঘরে ফিরিয়ে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এটা গোটা ভারতের কাছে গৌরবের। ক্রিকেট তারকা শচীন টেন্ডুলকার থেকে শুরু করে বিরাট কোহলি সবাই রাম মিন্দরে। অমিতাভ বচ্চনতো রামমন্দিরের পাশে জমি কিনে বাড়িই বানাচ্ছেন।
[৭] ৫৫০ বছরের অসম্মান থেকে রামকে রক্ষাকারী মোদীর গলায় অযোধ্যা-কর্মসূচির আগে উঠেছে সমীহ উদ্রেককারী সাধুসুলভ রুদ্রাক্ষের ডবল মালা। ডান হাতের কব্জিতে কালো কারের পাশে বাঁধা লাল ভক্তিমার্গ সূচক তাগা। খাচ্ছেন শুধু ডাবের জল। ঝাঁট দিচ্ছেন মন্দির। শয়ন মেঝেতে (হট্টমন্দিরে বললেও চলে)। অর্থাৎ, পবিত্র কর্তব্য সম্পাদনের আগে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন করে নিজেকে শুচিশুভ্র করে নিচ্ছেন। অযোধ্যায় মূল রাস্তা ধর্মপথ’র দু’পাশে তার বড় বড় হোর্ডিং পড়েছে। সোমবার সকালেই রামনগরীতে পৌঁছে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
[৮] অযোধ্যায় যাওয়ার অব্যবহিত আগে শনিবার মোদী গিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতে মন্দির সফরে। তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লির রঙ্গনাথস্বামী মন্দিরে (যে মন্দিরের সঙ্গে অযোধ্যার যোগসূত্র আছে বলে মন্দির কর্তৃপক্ষেরই দাবি) গিয়ে ‘কম্বা রামায়ণ’ শ্রবণ, হাতির সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং মাউথ অর্গান বাদন। রামেশ্বরমে সমুদ্রে ডুব। পুরাণ বলে, এই রামেশ্বরম দিয়েই নাকি সাগর পেরিয়ে লঙ্কাজয়ে গিয়েছিলেন সসৈন্য রামচন্দ্র। সেই পূতপবিত্র সাগরজল থেকে উঠে আসার পরে পরনে আকাশি কুর্তা-সাদা পাজামা আর চোখে চশমা পরেই মাথায় বালতি বালতি ঠান্ডা জল ঢেলে ধারাস্নান করলেন মোদী।
যোগী আদিত্যনাথ বর্ণিত রামমন্দিরের উচ্চতা ১৬১ ফুট। গোটা মন্দির চত্বরের আয়তন ২.৭ একর। মূল মন্দিরের [১০]এলাকা ৫৭,০০০ বর্গফুট। কিন্তু মন্দির নির্মাণে লোহা বা সিমেন্ট নয়, ব্যবহার করা হয়েছে গ্রানাইট পাথর, চুনাপাথর এবং শ্বেতপাথর। কারণ, লোহার আয়ু নাকি বড়জোর ৮০ থেকে ৯০ বছর। পাথরের একটি স্ল্যাবের মধ্যে অন্য স্ল্যাব ঢুকিয়ে লক অ্যান্ড কী পদ্ধতিতে তৈরি হচ্ছে তিনতলা মন্দির। যাতে অন্তত আড়াই হাজার বছর দাঁড়িয়ে থাকে মন্দির। ভূমিকম্পও টলাতে না-পারে। সরযূ নদীর পারের জমিতে বালির ভাগ বেশি। ফলে নির্মাণ শুরু করে ফাঁপরেই পড়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারেরা। শেষ পর্যন্ত মন্দিরের জমিতে ১৫ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে তুলে ফেলা হয়। সেই অতিকায় গহ্বর ভরানো হয় বালি-পলি-জৈব পদার্থের মিশ্রণে তৈরি বিশেষ মাটি দিয়ে। মন্দিরের গাঁথনিতে কোথাও ইস্পাতের রড ব্যবহার করা হয়নি। একের পর এক প্রায় ৫০টি স্তরে মাটি ভরাট করা হয়েছে। যাতে ভিত আরও মজবুত হয়। ভিতের উপর দেড় মিটার পুরু অধাতব কংক্রিটের স্তর। তার উপরে প্রায় সাড়ে ৬ মিটার পুরু গ্রানাইট পাথর। তার উপরে তিন থাকে মন্দির। একতলায় ১৬০টি, দোতলায় ১৩২টি এবং তৃতীয় তলে ৭৪টি চুনাপাথরের স্তম্ভ।