লুটেরা অর্থনীতির কারণে গড়ে উঠছে দেশে দেশে বেগমপাড়া
ড. মঞ্জুরে খোদা
বাংলাদেশে যতোটুকু অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে সেই মাত্রায় রাজনৈতিক উন্নয়ন হয়নি। আর যতোটুকু উন্নয়ন হয়েছে তার কয়েকগুণ লুটপাট, দুর্নীতি হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে যে ব্যয় হয়েছে তা দিয়ে দেশে কয়েকগুণ উন্নয়ন সম্ভব হতো। উন্নয়নের এই বাড়তি ব্যয় জনগণকে বহন করতে হচ্ছে। দেশে আর্থিক সংকট তৈরি করেছে। রিজার্ভের স্তর তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। দুর্নীতি ও লুটপাটের এই বাড়তি অর্থ কী হয়েছে? এর একটি বড় অংশ পাচার হয়েছে বিভিন্ন দেশে চলে গেছে। শুধু এই অর্থ নয়, সরকারি আমলাদের উপার্জিত দুর্নীতির অর্থ, অবৈধ ব্যবস্যা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ, ঋণের নামে ব্যাংক থেকে নেওয়া অর্থও বিদেশে পাচার হয়েছে। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত বলেছেন, খেলাপি ঋণ ও অর্থপাচার একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। যারাই ব্যাংক থেকে ব্যবস্যার নামে ঋণ নিয়েছেন তারা সেই অর্থের পুরো বা বড় অংশ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। এই অর্থেই লুটেরারা বিশ্বের দেশে দেশে গড়ে তুলেছেন বেগমপাড়া, পরিবার ও ভবিষ্যতের নিরাপদ আশ্রয়।
রাজনীতি একটি লাভজনক ব্যবস্যা বিনিয়োগ এখানে বিনিযোগের মুনাফা অল্পসময়ে বহুগুণ। যে যত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে তার সম্পদ গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নির্বাচনের আগে সিপিডির এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘যে যতবার নির্বাচন করেছে, তার আয় গাণিতিকভাবে ততো বেশি বেড়েছে। মানে (তার আয়) বৃদ্ধির হারের সঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বা নির্বাচিত হওয়ার একটা ইতিবাচক সম্পর্কে রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদে অধিকার পাওয়ার জন্য নাগরিক অধিকারের চেয়ে তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে ঢুকতে পারলে অ্যাকসেস টু স্টেট রিসোর্সেসের এটাই সবচেয়ে ভালো রাস্তা। আপনি যদি তার সঙ্গে থাকতে পারেন তাহলে ভাগ-বাটোয়ারাটার কিছু অংশ আপনি পাবেন, যা নাগরিক হিসেবে পাবেন না। ওই অংশের অংশ হিসেবে আপনি এটা পাবেন। অর্থাৎ পুরো রাষ্ট্রকে আপনি অধিকারহীন করে দিয়ে, সংকীর্ণ গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অধিকার ও মালিকানা দিচ্ছেন। এটাই হচ্ছে এই চরিত্রের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় কুফল।’
এমপি-মন্ত্রীদের মুনাফা বা আয় বৃদ্ধির কয়েকটি নমুনা; [১] রেজাউল করিম বাবলুর এমপির সম্পদ বেড়েছে ৭২৪ গুণ।
[২] শিক্ষামন্ত্রী দিপুমনির আয় বেড়েছে ৪১ গুণ, সম্পদ ৫৯ গুণ। [৩] খাদ্যমন্ত্রীর সাধন চন্দ্র মজুমদারের আয় বেড়েছে ১৫৭ গুণ, সম্পত্তি ৮৬ গুণ। [৪] পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সম্পদ ২ কোটি থেকে ৮৯ কোটি টাকা। [৫] বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির আয় বেড়েছে ২ হাজার ১৩১ শতাংশেরও বেশি। শুধু তাঁদের নয় তাঁদের বউ, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়দেরও আয় বেড়েছে শত থেকে হাজার গুণ। দেশের উন্নয়ন হলে এমপি-মন্ত্রীদের উন্নতি হবে না’ তা কি করে হয়?! কিন্তু সেটা কয় গুণ, কত গুণ? সেটা ২, ৪, ৫, ১০ গুণ নয়। একেবারে শত থেকে প্রায় হাজার গুণ, কিন্তু কীভাবে?? লুটপাট না হলে স্রেফ ব্যবস্যা করে কি এত গুণ, এত মুনাফা করা সম্ভব?? এই তথ্য হচ্ছে আকাশের নক্ষত্র দেখার মতোÑ খালি চোখে আমরা তার সামান্যই দেখতে পাই, আসল আকৃতি অদেখাই থাকে।
আমলা-ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের অবৈধ উপার্জন ও ক্ষমতার ত্রিভূজ : স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদের ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ছিল ১৮ শতাংশ। ২০২৪ সালে দ্বাদশ সংসদে ব্যবসায়ীদের সেই হার হয়েছে ৬৭ শতাংশ। পাঁচ দশকে জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। বর্তমান সংসদে ১৯৯ জন সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী। তার মানে সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশই তারা। দ্বাদশ সংসদে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া ৯৩ শতাংশই ব্যবসায়ী। অথচ ‘প্রথম জাতীয় সংসদে ২৮৩ আসনের মধ্যে সাড়ে ২৫ শতাংশ আইনজীবী, ২৩.৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী, ১৪.৮৪ শতাংশ কৃষক, ৯.৮৯ শতাংশ শিক্ষক এবং ১২.৩৬ শতাংশ রাজনীতিবিদ ছিলেন।’ (রওনক জাহান)
সংসদে অন্তত একজনের বিদেশে ২ হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান : মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে বলে জানিয়েছে টিআইবি। ওই মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনো বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছে, যার মূল্য ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।
অথচ তিনি তার নির্বাচনী হলফনামায় বিদেশে থাকা সম্পদের ব্যাপারে তথ্য দেননি। এটা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বলা হয়েছে। কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং হয়নি আরো এমন অনেকে নেতা আছেন যাদের বিদেশে বাসা-বাড়ি, ব্যবস্যা, সম্পদ, ব্যাংক-ব্যালান্স আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থে গড়েছেন কোন দেশে বেগমপাড়া।
কেন অর্থপাচারের নতুন কোনো তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে না? ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি ডলার, যা টাকায় প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকার বেশি। ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বা জিএফআই-এর প্রতিবেদন তাই বলছে। এই তথ্য ২০০৫-১৪ সাল এই নয় বছরের। কিন্তু এরপর জিএফআই বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ নিয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারেনি। সেটার কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে তারা আর এ বিষয়ে কোনো তথ্য পায়নি। যে কারণে অর্থ পাচারের নতুন কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারেনি। অথচ পত্রিকার বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায় এই সময়কালেই সবচেয়ে অধিক অর্থ বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে। সেটা ভাবলে আতকে উঠতে হয় যে দেশের অর্থ কীভাবে বিদেশে পাচার হচ্ছে?
বেগমপাড়া, অর্থপাচার ও লুটেরা বিরোধী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ : আজ থেকে তিন বছর আগে কানাডায় বেগমপাড়া ও লুটেরা বিরোধী একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এখন অনেকে প্রশ্ন করেন আপনাদের সেই আন্দোলনের খবর কী? আপনাদের সেই আন্দোলন দেশ-বিদেশে বেশ সাড়া ফেলেছিল, কিন্তু এখন কোনো আওয়াজ শুনি না। সেটার কারণ কী? ইত্যাদি। এককথায় এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। এখানে নানা ধরনের বিষয়, ভাবনা ও বাস্তবতা যুক্ত। এ আন্দোলন যখন গড়ে উঠেছিল তখন আসলেই এখানে একটা আলোড়ন তুলেছিল এবং ব্যাপকসংখ্যক মানুষ এর সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। এই আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনই করোনার ভয়াবহ । লকডাউনের কারণে প্রায় দুই বছর সব কিছু বন্ধ থাকে। এই আন্দোলনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় যদিও ভার্চ্যুয়ালি আমরা বেশ কিছু কর্মসূচি পালন করি। সেই কর্মসূচির কারণেও সংগ্রামটা জারি থাকে।
[১] এই আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়া নিয়ে আছে মিশ্রভাবনা। প্রবাসীদের একটি অংশ মনে করে এটা নিয়ে এখানে আন্দোলন করে কী হবে যদি না দেশে এগুলো নিয়ে কোন প্রতিকার হয়। [২] কানাডা সরকার যদি এদের এ দেশে প্রবেশ করতে বাধা প্রদান না করে তাহলে আন্দোলনে কোন ফল প্ওায়া যাবে না। তারা কীভাবে দেশ থেকে অর্থপাচার করে বিভিন্ন দেশে নিয়ে আসতে পারছে? তার উৎসমুখ যদি বন্ধ না করা যায় তাহলে তা পন্ডশ্রম হবে। সুতরাং আঘাতটা সেখানে আনতে হবে। সেক্ষেত্রে উভয় সরকারের মধ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা দরকার। [৩] আরেকটি অংশ মনে করে বেগমপাড়া, লুটেরা ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে লাভ নেই। কারণ যাদের মাধ্যমে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে তারাই এদের অংশীদার ও তাদের সহযোগিতা ছাড়া দুর্নীতিবাজরা এমন কাজ করতে পারতো না।
[৪] রাষ্ট্র ও সরকার যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় তাহলে শুধু ব্যক্তির সাথে শত্রুতা বাড়িয়ে কী লাভ? বিদেশে এসেছি একধরনের নিরাপদ ও শান্তির জীবনের জন্য তাকে বিঘ্নিত করবো কাদের জন্য, কীসের আশায় যদি না কোন ফল হয়? [৫] এখানকার একটি প্রভাবশালী অংশ যারা ব্যবসা-বাণিজ্য ও আইনপেশার সঙ্গে যুক্ত, যাঁরা এবং এই অবৈধ অর্থের সুবিধাভোগী তারা চায় না এখানে কোনো সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠুক। [৬] প্রবাসীদের ব্যস্ততা, বাস্তবতা ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার সংকটও একটি কারণ। তারা মনে করেন দেশ থেকে যে অস্থিরতা ও অশান্তির কারণে বিদেশে এলাম এখানেও যদি এগুলো করতে হয় তাহলে এখানে এসে লাভ কী হলো? [৭] আরেকটি হচ্ছে অরাজনৈতিক মানসিকতা। এরা মনে করে এগুলো আমাদের বিষয় নয়। আমি/আমরা নিরীহ মানুষ এগুলো রাজনীতি যারা করে তাদের বিষয় ইত্যাদি। [৮] কিছু মানুষ নিরাপত্তাজনিত কারণও এই আন্দোলন ও আলোচনায় অংশ নেওয়াকে নিরাপদ মনে করে না। প্রধানত।
বেগমপাড়া ও অর্থপাচার বিরোধী সামাজিক আন্দোলন রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতিতে কোন ভূমিকা রাখতে পারছে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু এটা নিয়ে তো বিতর্ক থাকার কথা নয় যে, যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করে, তাকে পথে বসিয়ে, বিদেশে অর্থসম্পদ পাচার করে তারা দেশের শত্রু, তাদের ঘৃণা করা উচিত, সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত? দেশে কোটি টাকার হিসাবধারীর সংখ্যা বর্তমানে দুই লাখ ৪৯ হাজার ৬৮৯ জন। এর মধ্যে গত ১৪ বছরে এ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এই সময়ে কোটিপতির সংখ্যা সাড়ে ৪ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ব্যাংকিং খাতের বাইরেও দেশে অনেকেই কোটিপতি হয়েছেন। যাদের অর্থ হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে। কোটি হওয়া অর্থবিত্তের মালিক হওয়া মোটেই দোষের কিছু নয়। কিন্তু লুটপাটের মাধ্যমে সরকারের পৃষ্টপোষকতায় কিছু ব্যক্তি কোটিপতি হবে তাকে সমর্থন করি কীভাবে? দেশের অর্থে বিদেশে বেগমপাড়া গড়ে উঠবে তার বিরুদ্ধে আর কিছু না হোক অন্তত ঘৃণা ও প্রতিবাদ থাকা উচিত। ড. মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংগঠক, লুটেরা বিরোধী মঞ্চ, কানাডা