জ্বালানি খাতে নজিরবিহীন লুটপাট সহায়ক ভ্রান্তনীতির কারণে গভীর সংকটে দেশ
গোলাম মোর্তোজা
বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের নজিরবিহীন ভ্রান্তনীতির পরিণতিতে মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। এ নীতিকে কেন নজিরবিহীন ভ্রান্তনীতি বলছি এবং দেশের মানুষের উপরে এই ভ্রান্তনীতির কুফল কীভাবে পড়ছে খুব সংক্ষেপে সুনির্দিষ্ট করে কিছু কথা বলবো। আপনার চোখের সামনে বিষয়টি খুব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এটিকে ভ্রান্তনীতি বলার কারণ হলো, বাংলাদেশের জ্বালানি তেল প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। আমাদের দেশের জ¦ালানি সেক্টরের মূল শক্তির যে জায়গা সেটা প্রাকৃতিক গ্যাস। আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ বহু আগে থেকে পাওয়া গেছে, কিন্তু এখন নতুন মজুত খুবই কম পাচ্ছি আমরা। বাংলাদেশ বিষয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠান আছে তারা সার্ভে করে কাগজে-কলমে সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন যে, বাংলাদেশের স্থলভাগে বিপুল পরিমাণ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভূ-তত্ত্ববিদ ড. বদরুল ইমামও বিষয়টি বারবার করে বলেছেন। ভ্রান্তনীতি কেন বলছি, কারণ গত ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশ তার গ্যাস অনুসন্ধানের পেছনে প্রায় কোনো শ্রম বা অর্থ ব্যয় করেনি। য ব্যয় করেছে সেটা একেবারেই নগণ্য।
শুধু একটি তথ্য দিইÑ পেট্রোবাংলা গ্রাহকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিয়েছিল এই কথা বলে যে, বাড়তি যে টাকাটা থাকবে সেটা দিয়ে তহবিল তৈরি করা হবে এবং তা দিয়ে নতুন গ্যাস ক্ষেত্রের অনুসন্ধান করা হবে। পেট্রোবাংলা সেই টাকা দিয়ে বিদেশ থেকে এলএনজি কিনে এনেছে, গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান করেনি। কেনাকাটায় আমাদের ব্যাপক আগ্রহ। চট্টগ্রাম শহরে গ্যাস সরবরাহ করা হয় দুটি ভাসমান এলএনজি প্ল্যান্ট থেকে। একটি মার্কিন কোম্পানি, অন্যটি সামিট। স্বাভাবিকভাবে এলএনজি টার্মিনালে সমস্যা হলে সেটার প্রভাব চট্টগ্রাম শহরে পরে যা এখন খুব বিপর্যয়কর পর্যায়ে চলে গেছে। আর সারা দেশের প্রেক্ষিতে যে সমস্ত জায়গায় গ্যাস আছে সেগুলোতে অনুসন্ধান করা হয়নি, এলএনজি কিনে আনা হয়েছে। কেন এলএনজি কিনে আনা হয়েছে? কারণ সরকার যুক্তি দিয়েছিলো যে অনুসন্ধানের চেয়ে আমরা বিশ্ব বাজার থেকে এলএনজি কিনে আনতে পারি। কারণ এলএনজি কেনা অনুসন্ধানের চেয়ে বেশি লাভজনক। কিন্তু এলএনজির বাজার যে অস্থির হতে পারে এবং আমাদের রিজার্ভ যে সবসময় অফুরন্ত নাও থাকতে পারে সেটা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বিবেচনা না করে শুধু আমদানির দিকে যাওয়া হয়েছে। অনুসন্ধান করা হয়নি। এতো করে দেশের মজুত কমে গেছে। পেট্রোবাংলার তহবিল দিয়ে বাপেক্সের সাহায্যে অনুসন্ধান করার কথা ছিলো সেটাও হয়নি। আমাদের পাশের সেক্টর গুলো থেকে মিয়ানমার, ভারত গ্যাস উত্তোলন করছে। কিন্তু আমরা বসে আছি কিনে আনার জন্য। এখন কিনে নেওয়ার পর্যায়টি দাঁড়িয়েছে যে সামিট গ্রুপ, বাংলােেদশের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ছিলো এখন তারা সিঙ্গাপুরের ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠান। তারা সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনী। এক ভাই আমাদের এমপি (মন্ত্রী) আরেক ভাই সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনী।
সামিট পেট্রোবংলাকে বছরে ১৫ লাখ টন এলএনজি সরবরাহ করবে। মজার ব্যাপার হলো, এখানে দুই রাষ্ট্র চুক্তি করছে না। বাংলাদেশ চুক্তি করছে একটি বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে। উৎপাদন না করে এই যে কেনাকাটায় চলে যাওয়া, এটি বাংলাদেশের জ্বালানি সেক্টরের সবচেয়ে বড় ভ্রান্তনীতি। এই ভ্রান্তনীতির মূল্য দিতে হচ্ছে জনগণকে। গ্যাস সংকটের মূল্য জনগণ কীভাবে দিচ্ছে? গ্যাস থাকুক বা না থাকুকÑ দুই বার্নার চুলার জন্য দিতে হয় মোট ১০৯০ টাকা। অথচ শর্ত ছিলো এরকম যে গ্যাস সরবরাহ করা হলে তার বিপরীতে টাকা, কিন্তু এখন গ্যাস সরবরাহ না করেই টাকা! মানুষের সঙ্গে কী ধরনের প্রতারণা হচ্ছে ভাবুন। বর্তমানে আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছি তার মূল্য বেড়ে যাবে প্রায় ৮১ শতাংশ। পিডিবি এরকম একটি প্রস্তাব তৈরি করছে। এখন যে বিদ্যুতের মূল্য দিচ্ছি ৮.৩০ টাকার মতো সেটি যদি ফেব্রুয়ারি থেকে পিডিবির প্রস্তাব অনুযায়ী বাড়ানো হয় তাহলে সেটি হবে ১৫.৩০ টাকা। হয়তো ১৫.৩০ টাকা বাড়াবে না কিন্তু ১২ টাকা হবে। তার মানে ভ্রান্তনীতির কারণে খরচ বাড়বে। এত বেশি মূল্য দেওয়ার পরেও ২০২২-২০২৩ সালে পিডিবি লস দিয়েছে ৫১ হাজার ৩শ কোটি টাকা। কেন এত লস দিতে হলো, শুধু ভ্রান্তনীতির জন্য। বিদ্যুৎ খাতে ডলারে দেড়লক্ষ কোটি টাকার বেশি মূল্য শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে। আমাদের রিজার্ভ কমে যাওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটি একটি।
আমাদের ডলার আয়ের জায়গাটা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। তৈরি পোশাক আমাদের আমাদের ডলার আয়ের অন্যতম প্রধান একটি খাত। আমাদের তৈরী পোষাকের রপ্তানী যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১০শতাংশ,ইউরোপে প্রায় ১.৫০ শতাংশ কমে গেছে। সে সমস্থ দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে রপ্তানী কমে যাচ্ছে। তার মানে হচ্ছে বাংলাদেশের জ্বালানি সেক্টরে যে সম্ভাবনা ছিলো সেগুলোকে কাজে না লাগিয়ে আমরা শুধু আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছি। আমরা গ্যাস আমদানি নির্ভর হতে গিয়ে ক্রমান্বয়ে মূল্য বৃদ্ধি করছি এবং এক পর্যায়ে আমাদের রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে আমারা সামগ্রিক আমদানি ব্যায় কমিয়ে ফেলেছি। গতবছর প্রায় ২১ শতাংশ আমদানি কমেছে যার মধ্যে খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে জ্বলানি ও আছে। জ্বালানি আমদানি কমিয়ে ফেলার কারনে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বসে থেকেছে আর লোডশেডিং হয়েছে। বসিয়ে রেখে তাদেরকে ডলারে ক্যপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছে। জ্বালানি খাতের প্রধান সংকট হলো ভ্রান্তনীতি। জ্বালানিখাতের ভ্রান্তনীতির কারণে আমরা কোটি কোটি ডলার খরচ করেছি কিন্তু আমাদের টেকসই উৎপাদন ব্যাবস্থা হয়নি।
শীতকালে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে, কিন্তু যখনই গরম আসবে ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি আমদানি করতে না পারার জন্য ভয়াভহ লোডশেডিং আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের খুশি করা হয়েছিলো এটা বলে যে আগে বিদ্যুৎ ছিলো না এখন আছে। কিন্তু এই বিদ্যুৎ পাওয়ার পেছনে যে কি পরিমাণ মূল্য দিতে হয়েছে বা নজিরবিহীনভাবে অনিয়ম হয়েছে, সেটি আমরা বিবেচনায় নেয়নি। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদন যে টেকসই হয় না সেটি আমরা গতবছর আমরা বুঝেছি এবং আগামীতেও বুঝব। অর্থাৎ জ্বালানি সেক্টরে যে একটি সমন্বিত সু-পরিকল্পনার দরকার ছিলো আমরা সেখানে কু-পরকিল্পনা করেছি, নজিরবিহীন ভ্রান্তনীতি করেছি যার ফলে চট্টগ্রাম, ঢাকার মানুষ বাড়িতে, কারখানায় চাহিদা মতো গ্যাস পাচ্ছে না। পাওয়ার সম্ভাবনাও খুবই কম। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস আমাদের জনগণের সম্পদ। জনগণের সম্পদের যে নজিরবিহীন অপব্যাবহার, অনিয়ম এবং ভ্রান্তনীতি তার সুফলতো দূরের কথা কুফল পাচ্ছে ভুক্তভোগী জনগণ। তাদের শুধু মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে এবং সে মূল্য কিছু সংখ্যক ব্যাক্তি বা কোম্পানি নিয়ে যাচ্ছে। এই ভাবে যারা টাকা আয় করে তারাই বিদেশে টাকা পাচার করে। এই ভ্রান্তনীতির মূল্য আমাদের দেশের জনগণকে যে আরো কতটা দিতে হবে সেটি গবেষণার দাবি রাখছি।
পরিচিতি : সিনিয়র সাংবাদিক। গোলাম মোর্তোজা ফেসবুক পেজের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস