সামরিক জান্তা বার্মার অর্থনীতির যে ক্ষতি করেছে?
ওয়াসি মাহীন
৬,৭৬,৫৭৮ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল দেশ বার্মা যা বাংলাদেশের থেকে প্রায় সাড়ে চার গুন বড়। প্রকৃতি কি দেয়নি বার্মাকে? ২০০০ বছর আগে মন ডাইনাস্টির আমলেও বার্মা ছিল অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। ব্রিটিশ বার্মা ছিল সাউথ ইস্ট এশিয়ার দ্বিতীয় সমৃদ্ধশালী অঞ্চল। ফিলিপাইনের পর সব থেকে ধনী ছিল বার্মা। তখন থেকেই আফিম উৎপাদনে বিশ্বের প্রথমসারির দেশ ছিল বার্মা। পরবর্তীতে আফিম চাষ বন্ধ হলে বার্মাকে অর্থনৈতিক ভাবে বেশ বিপদে পড়তে হয়। রুবি, জেড পাথর সহ মহামূল্যবান পাথর বার্মাতে এত বেশি পাওয়া যায় যে বার্মা এক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে।
এই অঞ্চলের মানুষ উপমহাদেশের মত গরিব কখনো ছিলনা। বার্মার সব থেকে বাজে অবস্থা হয় সামরিক শাসন আসার পর। জবাবদিহিতা না থাকায় চলতে থাকে সীমাহীন দূর্নীতি যা বার্মার সমৃদ্ধি কে শেষ করে দেয়। বন্ধ হয়ে যায় বিদেশি বিনিয়োগ। থমকে যায় অর্থনীতি। বেসরকারি ভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন বন্ধ হয়ে যায়। এর উপর রয়েছে অবরোধ। সারা বিশ্ব হতে বিছিন্ন হয়ে পড়ে বার্মা। সেই সময়টি কাজে লাগিয়েছে চীন। নিজেদের প্রভাব বাড়িয়ে হাতিয়ে নেয় অধিকাংশ খাত। এসব বিষয়ে শেষে আলোচনা করব।
প্রাকৃতিক সম্পদে প্রাচুর্যের পরো বার্মার অর্থনীতি এখন অনেক পিছিয়ে। ২০১৭ সালে তাদের জিডিপি ছিল প্রায় ৬৯.৩২২ বিলিয়ন ডলার। আপাতদৃষ্টিতে এটা অনেক কম মনে হলেও এখানে ভিন্ন কিছু বিষয় রয়েছে যা শেষ অংশে আলোচনা হবে। তবে নিসন্দেহে বলা যায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সব থেকে সমৃদ্ধশালী দেশটি এখন এই অঞ্চলের সব থেকে তলানিতে রয়েছে। তাদের যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে এগুলা সঠিক উপায়ে কাজে লাগালে তাদের এতদিন ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া কে ছাড়িয়ে যাওয়া উচিত ছিল। তারা সেটা পারেনি শুধু সামরিক শাসনের জন্য। সামরিক শাসনে তাদের শিক্ষার পেছনে ব্যয় সব থেকে কম যেটা তাদের জনগণকে এক প্রকার অন্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে রেখেছে।
জিডিপি গ্রোথ ২০১৭ সালে ছিল ৬.৪%। বার্মার প্রেক্ষিতে এই প্রবৃদ্ধি খুব কম। মাথা পিছু আয়ে বার্মা বাংলাদেশের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে তারা এদিকে পিছিয়ে পড়ে। ২০১৭ সালে তাদের মাথা পিছু আয় হয়েছে প্রায় $১৩০০ ডলার। বার্মার মত দেশে বৈদেশিক ঋন খুব কম থাকার কথা থাকলেও আদতে তা নয়। মাত্র $৬৯ বিলিয়নের অর্থনীতির দেশে বৈদেশিক ঋন প্রায় $৯.৭১১ বিলিয়ন ডলার। মূলত সীমাহীন দূর্নীতিঃ ও জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি এই অবস্থার কারণ। মোট ঋন যদিও এখন তুলনামূলক কম। তাদেএ জিডিপির ৩৬.৭৫% হল ঋন। যেটা এক সময় তাদের জিডিপি থেকেও বেশি ছিল। নিজেদের সম্পদ বিক্রি করে তারা সেটা কমিয়ে আনতে পারছে।
বার্মার ডলার রিজার্ভ তাদের বৈদেশিক ঋণ হতে অনেক কম। ৯.৭১১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে তাদের রিজার্ভ রয়েছে মাত্র $৫.০৩২ বিলিয়ন ডলার।
বার্মাতে তাদের সুযোগ অনুযায়ী কোন ভারি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেনি। তাদের মোট জনবলের ৭০% এখনো কৃষি কাজের সাথে যুক্ত যেটা প্রমাণ করে তাদের অর্থনীতি এখনো শিল্প বিল্পব দেখেনি। শিল্পে তাদের মাত্র ৮% জনবলের কর্মসংস্থান হয়। বাকি ২২% যুক্ত আছে সার্ভিস সেক্টরে।
যখন কোন দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান বেশি থাকে তখন বুঝে নিতে হয় দেশটি শিল্পায়নে যথেষ্ট পিছিয়ে। বার্মার জিডিপিতে কৃষির অবদান প্রায় ২৪.৮% যেটা বাংলাদেশে মাত্র ১৪%। শিল্পের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি কিছু শিল্প রয়েছে বার্মায়। তবে এগুলার অধিকাংশ ইয়াঙ্গুন কেন্দ্রিক। শিল্পের অবদান ৩৫%। বাকিটা সার্ভিস সেক্টরে।
তবে বৈদেশিক বিনিয়োগে সম্প্রতি বার্মা এই অঞ্চলের সব থেকে আকর্ষণীয় হতে উঠেছিল। যা তাদের ২০১২ সাল হতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বিনিয়োগ চিত্র দেখলেই বুঝা যায়। তবে তাদের এই উন্নতির সব থেকে বড় বাধা হিসাবে আসে রোহিঙ্গা সংকট। এই কারনে ইউরোপের বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। বিনিয়োগ পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবার কারণে অনেক দেশ বিনিয়োগ প্রস্তাব ফিরয়ে নেই। ব্যাতিক্রম শুধু চীন।
বার্মায় কিছু বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠতেছে যেটা বার্মাকে শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি দেবার জন্য করা হচ্ছে। বার্মাতে বিনিয়োগে শীর্ষে আছে সিঙ্গাপুর, চীন। জাপান চতুর্থ অবস্থানে। শুধু জাপানের বিনিয়োগ চিত্র কিছুটা তুলে ধরি আপনাদের বুঝার জন্য।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জাপান বার্মাতে চতুর্থ অবস্থানে। ২০১১ সাল থেকে সামরিক প্রভাব কমে সিভিল গভর্মেন্ট আসার পর থেকেই এবং প্রশাসনিক সংস্কার করার পর থেকেই ধেয়ে আসতেছে বিদেশি বিনিয়োগ।
জাপান ২০১৭ সালেই দেশটিতে বিনিয়োগ করেছে প্রায় ১.৪৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১২ সালে জাপানের বিনিয়োগ ছিল ২৫২ মিলিয়ন ডলার। যা ২০১৩, ১৪, ১৫ এবং ১৬ সালে যথাক্রমে হয়েছে $৫৫ মিলিয়ন, ১.০২ বিলিয়ন, ৫৯০ মিলিয়ন এবং ২৮০ মিলিয়ন।
সব মিলিয়ে বিগত ৬ বছরে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় $৩.৬৭৭৭ বিলিয়ন ডলার।
তিলাওয়া ইকোনমিক জোন বাস্তবায়ন হলে বার্মার চেহারা পরিবর্তন হয়ে যাবে। জাপানের $৩.২৮ বিলিয়ন ডলারে গড়ে উঠতেছে বার্মার সব থেকে বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল। ২৫০০ হেক্টর বা ৬২০০ একর জমির উপর এটি নির্মাণ করা শেষ হলে বিলিয়ন ডলারের জাপানিজ বিভিন্ন কোম্পানির বিনিয়োগ পাবে দেশটি।
একি ভাবে চীনের সমুদ্রবন্দর সহ অনেক প্রকল্প চলমান। সম্প্রতি বৈদেশিক ঋনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবার প্রেক্ষিতে বার্মা চীনকে দেয়া গভীর সমুদ্র বন্দরের আকার ছোট করতে বলেছে। ৯ বিলিয়নের প্রজেক্টের খরচ কমিয়ে $১-২ বিলিয়নে নামিয়ে আনতে চাইছে। ফলে আগে যেখানে বন্দরটিতে কয়েক ডজন মাদার ভেসেল ভীড়তে পারত সেটিকে কমিয়ে দুইটি জাহাজ ভেড়ার মত করে বানাতে বলেছে। বার্মা বুঝেছে এত বৃহত বন্দর বার্মার থেকে চীনের বেশি কাজে লাগবে। বার্মার জন্য দুটি জাহাজ ভেড়ানোই যথেষ্ট। দেখা যাক কি হয়।
একটা দেশের অর্থনীতি একটা পোস্টে বর্ণনা করা কঠিন। তাই ছোট করে দ্বিতীয় অংশে চলে যায়।
টাকা সেটা আবার সাদা টাকাও হয় আবার কালো টাকাও হয়। দূর্নীতিঃ, অবৈধ পথে আয়, বৈধ পথে আয় কিন্তু ট্যাক্স ফাকি দেয়া সহ অনেক কারনে উপার্জিত অর্থ কাল টাকা নামে পরিচিত। অনেক সময় এই টাকা বিদেশে পাচার করা হয়। কালো টাকার বিশাল অংশ জিডিপিতে দেখানো হয়না বা যায়না। আমাদের দেশে যার আয় মাসে ৫ লাখ সেও আয়কর দিতে গেলে আয় দেখায় ২০ হাজার টাকা।
যাহোক ব্লাক ইকোনমি নিয়ে বাংলাদেশে খুব বেশি সমীক্ষা চালানো হয়নি। তাই অবৈধ অর্থের সঠিক হিসাব জানা সম্ভব হয়না। তবে অনুমান করা যায়।
আগে বাংলাদেশের ব্লাক ইকোনমি বা শ্যাডো ইকোনমি কিছুটা বলা যাক। বাংলাদেশে ছায়া অর্থনীতির আকার দুই ভাবে বের করা হয়েছে । এই দুই পদ্ধতিতে যেটুকু জানা গেছে সেটি হল ৭০ এর দশকে ছায়া অর্থনীতির আকার ছিল আমাদের মোট জিডিপির প্রায় ২০%। ১৯৯৬ সালে এটি বেড়ে প্রায় ২৯% এ দাঁড়ায়। ২০০৪ সালে এটি সর্বোচ্চ ৪৬% এ দাঁড়ায়। তবে ২০০৮ সালে ব্লাক অর্থনীতি কমে ৩৪% এ চলে আসে।
বার্মার মাথা পিছু আয় কম বলে মনে হলেও আমরা যদি একটু গভীর দৃষ্টিতে দেখি তাহলে বুঝতে পারব যে তাদের প্রদর্শিত অর্থনীতি থেকে ছায়া অর্থনীতির আকার সমান বা বেশি হবার কথা। কোন ভাবেই কম নয়। এর কিছু কারন বলছি।
থাইল্যান্ড এ ২০১০ সালেই জানা মতে ১ বিলিয়ন মেথামফেটিন বা ইয়াবা ট্যাবলেট পাচার করা হয়। যেটা ২০১০ সালের হিসাবে ছিল প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার মূল্য ছিল। বর্তমানে সঠিক হিসাব না জানলেও ধারনা করা যায় যে সেই পরিস্থিতি কয়েকগুন অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশেই ধারনা করা হয় যে প্রায় ৪০০০০ কোটি বা $৫ বিলিয়ন ডলার মূলয়ের ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে প্রতিবছর। সেক্ষেত্রে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল এ বসে বার্মার সব থেকে বড় কাস্টমার থাইল্যান্ড সহ অন্যান্য দেশে কি পরিমান পাচার হচ্ছে কল্পনা করুন। প্রতিবছর ইয়াবা বিক্রি করে যে পরিমাণ কালো টাকা ওদের হাতে আসে তা দিয়ে ওদের ৯ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋন এক বছরেই শোধ করা সম্ভব। আমরা অনেকে ভাবতে পারি যে বার্মার সৈন্যদের বেতন বাংলাদে্ি টাকায় মাত্র ৮-১০ হাজার টাকা। কিন্তু ওদের দূর্নীতি গ্রস্থ সেনাবাহিনীর আসল আয় আসে এই ইয়াবা ব্যাবসা থেকে। সীমান্তে অবাধে পাচারে সহায়তা করে তারা।
বিভিন্ন সুত্র মতে তাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৪০% আসে অবৈধ উপায়ে। তাহলে বুঝতেই পারছেন এত টাকা ওরা পায় কই? বাজেট আমাদের থেকে কম হলেও ওদের কাচা টাকা অনেক বেশি।
কাচা টাকার একমাত্র উৎস যে শুধু ইয়াবা তা নয়। বরং বার্মা শেগুন কাঠ রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম। অবৈধ পথে বিপুল পরিমাণ কাঠ পাচারে যুক্ত থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে তারা।
সব থেকে বড় ব্যাপার হল মহামূল্যবান পাথর। সারা বিশ্বের চাহিদা মেটায় বার্মা। রুবি, জেড পাথর, স্যাফ্যায়ার সহ বিভিন্ন অমুল্য পাথর রয়েছে তাদের। ধারনা করা হয় সামরিক শাসনের সময় এসব পাথরের অধিকাংশ লেনদেন হয়েছে অবৈধ উপায়ে। মুলত চীন এর প্রধান ক্রেতা। অনেক ক্ষেত্রে এসব মূল্যবান সম্পদের বিনিয়নে তারা অস্ত্র আমদানি করেছে। বুঝতেই পারছেন কেন চীন বার্মাকে অন্ধের মত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বার্মা থেকে চীন যা পাবে বাংলাদেশ বা অন্য দেশ থেকে সেটা পাওয়া কখনোই সম্ভব না।
সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট বার্মা সফর করে গেছে। মোট ৩৩ টি চুক্তি করা হয়েছে। এর ভেতর অন্যতম হল গভীর সমুদ্রবন্দর, দ্রুতগামী রেলপথ, স্পেশাল ইকোনমিক জোন। চীনের সাথে বার্মার অর্থনৈতিক সম্পর্কের নতুন সূচনা হয়েছে। যাকে বলা হচ্ছে সিমেক। বার্মা তাদের সম্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে গেলে উন্নত দেশের কাতারে থাকত। বার্মার বর্তমান অবস্থানের জন্য দায়ী সামরিক শাসন। সামরিক শাসনের ফল ভাল ফল বয়ে আনে না। লেখক: সাবেক ব্যাংকার( ফেসবুক পোস্ট তেকে নেয়া)