ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের অনিয়ম বন্ধ হবে, নাকি আরও বাড়বে?
গোলাম মোর্তোজা
বাংলাদেশের আর্থিক খাতে কোন মাত্রার নৈরাজ্য বা বিশৃঙ্খলা গত ১৪-১৫ বছর ধরে চলছে, সেটি আমরা সবাই জানি। ২০ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে বলা হয়েছে যে, ইসলামী ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, জবাবদিহিও নেই। এখানে সবকয়টি ব্যাংক এসআলম গ্রুপের মালিকানাধীন। আমার ইউটিউব চ্যানেলে একটি জরিপ বা মতামতের মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলাম যে, আর্থিক খাত থেকে ঋণ জালিয়াতি বা লুটপাটের মাধ্যমে যে অর্থ চলে গেছে সেগুলো সরকার ফেরত আনার চেষ্টা করবে কিনা। সেখানে প্রায় সবই নেতিবাচক মন্তব্য এসেছে। টাকা ছাপিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বা গভর্নর তার বিশেষ বিবেচনায় ৫টি ব্যাংককে অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য। ব্যাংকগুলো হলোÑ ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক যার সবগুলো এসআলম গ্রুপের মালিকানাধীন। এই ব্যাংকগুলো ভয়াবহ রকমের আর্থিক সংকটে পড়েছে। ইসলামী ব্যাংক এদেশের আর্থিকভাবে লাভজনক সবচেয়ে বড় ব্যাংক।
মালিকানা পরিবর্তন করে এসআলম গ্রুপের হাতে দেওয়ার পর এ ব্যাংকটি এখন আর্থিক সংকটে আছে। কীভবে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ বিবেচনায় আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে? অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, কয়েকটি ইসলামী ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করেছে বলে গর্ব করে, কিন্তু বাস্তবে কয়েকটি ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংককে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। টাকা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া কি আর কিছুই করার ছিলো না। গমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী আমরা জেনেছি যে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিয়েছে এসআলম গ্রুপ কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও অন্যান্য যে শরীয়া ভিত্তিক ব্যাংকগুলো আছে তাদের কাছ থেকেও নামে-বেনামে, ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নাম করে বিপুল পরিামাণে ঋণ নিয়েছে তারা। প্রশ্ন হলো, যাদের মালিকানাধীন ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন যে একটি ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে, ব্যাংকগুলোকে এখন বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করার নামে টাকা ছাপিয়ে ঋণ না দিয়ে তাদের থেকে টাকা উদ্ধারে কি বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ভূমিকা রাখতে পারতো না?
বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয়ই পারতো, কিন্তু সেটি করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর খুব জোড় দিয়ে বলেছিলেন যে তিনি কাউকে ভয় পান না। কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি ভয় না থাকে তাহলে এসআলম গ্রুপের নামে যখন টাকা পাচারের অভিযোগ আসলো, বিদেশে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অভিযোগ আসলো, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা নাম উল্লেখ করে গমাধ্যমের কাছে কেন এই বক্তব্য দিতে পারলেন না যে, এস আলম গ্রুপ বিদেশে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে একটি টাকাও নিয়ে যায়নি। ভয় যদি না থাকে, তাহলে বাংলাদশ ব্যাংকের গভর্নর সাহেব এই কথাগুলো বলতে পারলেন না কেন এবং এস আলম গ্রুপের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার না করে আরও টাকা ছাপিয়ে দিচ্ছেন কেন? আমার ইউটিউব চ্যানেলে বোঝার জন্য একটি প্রশ্ন করেছিলাম যে, ‘আর্থিক খাত থেকে যে অর্থ লুটপাট হয়ে গেছে নতুন সরকার সে অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করবে কী না’? ১১ ঘণ্টায় ১২ হাজার মানুষ ভোট দিয়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন ১০৬ জন। ১২ হাজারের মধ্যে ৪ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে ‘হ্যাঁ’, ২৮ শতাংশ মানুষ ‘সরকার চেষ্টা করবে না’তে, ‘সরকারের এই মেয়াদে আর লুটপাট হবে না’ এখানে ভোট দিয়েছে ১ শতাংশ মানুষ, ‘সরকারের এই মেয়াদে আরও বেশি লুটপাট হবে’ এখানে ৬৭ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে।
উল্লেখ্য যে এটি কোনো প্রচলিত ধারার জরিপ নয়। যারা শুধু অনলাইনে এসেছেন তারা তাদের মতামত জানিয়েছেন। পাবলিক পারসেপশন বুঝার জন্যে এটির কি কোনো গুরুত্ব আছে? আমি ধারণা করছি আছে। এর মাধ্যমে মানুষের মনোভাব অন্তত বুঝা যায়। ১২ হাজারের ৬৭ ভাগ মানুষই মনে করছেন যে এই মেয়াদেও ঋণ জালিয়াতি বা আর্থিক খাতের লুটপাট বেশি হতে পারে। প্রচলিত ধারার জরিপ না হলেও সাধারণ মানুষের মতামত বোঝার জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় টুলস। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ, রিজার্ভ কমে গেছে, আমদানি ব্যয় কমাতে হচ্ছে, আমদানি ব্যয় কমাতে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্য আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে, জিনিসের দাম বাড়ছে, এই অবস্থায় যদি আর্থিক খাতে এরকম বিশৃঙ্খলা অটুট থাকে বা আরও বাড়ে তাহলে আগামীর বাংলাদেশের চিত্রটা কেমন হবে? আমরা ভাবলে খুব স্বস্থিদায়ক কিছু ভাবতে পারি না। একধরনের আতঙ্কের ছবি সামনের সময়টিতে দেখি। জানি না বাস্তবে কী ঘটবে। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, গোলাম মোর্তোজার ফেসবুক পেজের ভিডিও কনন্টেন থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস