দেশের শিল্প খাতে এফডিআইয়ের বিপুল সম্ভাবনা
জোহরা ইয়াসমিন : স্বাধীনতার ৫২ বছরে কৃষিতে নীরব বিপ্লব ঘটেছে যার ফলশ্রুতিতে কৃষি খাত ও কৃষক সম্প্রদায় দেশের প্রায় ১৭০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করছে। এখন এই প্রজন্মের কৃষকরাই কারখানায় কাজ করে বাংলাদেশকে উন্নয়নের চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে বেসরকারি খাতের শিল্প ৩ হাজার থেকে বেড়ে প্রায় ৮৮ লাখ কারখানা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০৩৫ সালে বিশ্বের ২৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি হতে চলেছে, যেখানে দেশের ৮৫ মিলিয়ন কর্মক্ষম লোকের অন্তত ৮০-৮৫ শতাংশ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য বেসরকারি খাতের উপর নির্ভরশীল। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ থেকে পুরোপুরি শিল্পোন্নত দেশে চলে যাচ্ছে। ১৯৭৩ সালে পাটজাত পণ্য ছিলো মোট রপ্তানির ৫২ শতাংশ। এর পাশাপাশি চা, চিনি, কাগজ ও চামড়া শিল্প খাতও ধীরে ধীরে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর সরকারের জাতীয়করণ নীতি ও তার প্রায় এক দশক পর বেসরকারিকরণ নীতির ফলে দেশের শিল্প খাতে অনেক উত্থান-পতন ঘটে, যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে অগ্রগতির দিকে মোড় নেয়। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিএনপি) কৃষি খাতের অবদান ছিলো ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ। আর শিল্প ও সেবা খাতের অবদান যথাক্রমে মাত্র ৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও ৩৪ শতাংশ। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি পরিবর্তিত হয়েছে, শিল্প ও সেবা খাতের ক্রমবর্ধমান বিকাশের সঙ্গে, যা অর্থনীতির মৌলিক কাঠামোকে পরিবর্তন করেছে। শিল্পায়নের সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা ও শিল্পায়নের মাধ্যমে এক কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মূল লক্ষ্য নিয়ে সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে।
শিল্প ও বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে দেশের অর্থনীতি দ্রুত গতিতে চলছে। বিশ্বের ৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে যার আওতায় খাতভিত্তিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ১৯০টি দেশে। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে কৃষি ও আমদানি নির্ভর দেশ থেকে উৎপাদন রপ্তানিমুখী দেশে পরিবর্তিত হয়েছে। শিল্প খাতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধুমাত্র ক্ষুদ্র শিল্পে প্রায় ৬ মিলিয়ন শ্রমিক কাজ করছে। এছাড়া কুটির, মাঝারি, বৃহৎ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, শিল্প মালিক, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে মোট আড়াই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। বিবিএসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে কুটির শিল্পের সংখ্যা ৬৮ লাখ ৪২ হাজার, ক্ষুদ্র শিল্প রয়েছে ১০ লাখের বেশি, ক্ষুদ্র শিল্প প্রায় ৯ লাখ, মাঝারি শিল্প ৭ হাজার ও বড় শিল্প রয়েছে ৫ হাজার ২৫০টি। দেশে মোট শিল্পের সংখ্যা প্রায় ৮৮ লাখ।
এই সবই বেসরকারি খাতের দ্বারা সম্প্রসারিত হয়েছে। এছাড়া শিল্পায়ন বা শিল্প খাতকে আরও গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচনা করে শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত করতে ২০১১ সালে ঘোষণা করা হয় শিল্পনীতি-২০১০। এই নীতির মূল উদ্দেশ্য হলো উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার মূল স্রোতে নারীদের নিয়ে আসা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআরইউ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সংস্থাটি ধারণা দেয় যে এটি ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হবে। করোনার প্রভাব কিছুটা থেমে গেলেও সামগ্রিক চিত্র বলছে বাংলাদেশ সেই পথেই হাঁটছে ও প্রাথমিক শর্ত পূরণ করতে পেরেছে। উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশের শর্ত যা ২০২৬ সালে চূড়ান্ত রূপ নেবে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই-এর ভূমিকার উপর ভিত্তি করে, ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বিনিয়োগে বেসরকারি খাতের ভূমিকা আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ হবে মোট বিনিয়োগের ৭৫ শতাংশ। মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর অধ্যায় ৩-এ যেমন আলোচনা করা হয়েছে ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময় বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের এফডিআই-এর বর্তমান প্রবাহ জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ থেকে জিডিপির ৩ শতাংশে উন্নীত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে।
এফডিআই-এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগ ও বেসরকারি খাতের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় সীমিত বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে ৩ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে উন্নীত হবে। এটি ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার একটি বড় কৌশলগত পরিবর্তন যা বেসরকারি বিনিয়োগ ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে এভাবে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সময়কালে বেসরকারি বিনিয়োগের স্থবির অবস্থার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে ও প্রযুক্তি উন্নয়ন, জ্ঞান স্থানান্তর ও দক্ষতা বিকাশের প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে এফডিআই একটি প্রধান ভূমিকা পালন করবে। স্বাধীনতার আগে পাট ছিলো দেশের প্রধান রপ্তানি খাত ও এখন এটি পোশাক খাত। এই খাত মোট রপ্তানির ৮০% এর বেশি ও ৫ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান প্রদান করে। আর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের প্রায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান এই খাতের ওপর নির্ভরশীল, যার পুরোটাই বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি শিল্প, রড, সিমেন্ট, বিভিন্ন ধরনের রং, রাসায়নিক, ওষুধ, জাহাজ ভাঙ্গা ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ অনেক শিল্প গড়ে উঠেছে। গত এক দশকে রপ্তানি আয় কয়েকগুণ বেড়েছে ও সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) তত্ত্বাবধানে সারাদেশে ১০০ টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। শুধু চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ৩০ হাজার একরের বেশি জায়গা জুড়ে গড়ে উঠছে সুপরিকল্পিত বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী। এটি ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এক সময়ের কৃষিপ্রধান দেশ শিল্পে পরিণত হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন স্বাধীনতার সময় মাথাপিছু আয় ছিলো মাত্র ১২৩ ডলার। এখন তা ২ হাজার ২৬৬ ডলারের উপরে। কৃষিনির্ভরতা ছেড়ে শিল্পনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তায় বেসরকারি খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আশা করা যায় ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে বাঙালি জাতির স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। বিশ্বব্যাংক জানায় ১৯৭০ সালে জিএনপির আকার ছিলো মাত্র ৪৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩ হাজার ২৭৬ বিলিয়ন টাকা। আর গত অর্থবছরে স্থির মূল্যে দেশের জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা, যা প্রমাণ করে অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। এটা ঠিক যে বাংলাদেশে ছোটখাটো শিল্প বিপ্লব হয়েছে কিন্তু শ্রমিকদের কারিগরি জ্ঞানের অভাব, খনিজ ও জ্বালানি সম্পদের অভাব, বৈদেশিক সাহায্যের অভাব, শিল্প ঋণের অভাব, সঠিক পরিকল্পনার অভাব ইত্যাদি চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পরিকল্পিত শিল্পায়ন, বিদেশে বাজার সৃষ্টি, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে বাংলাদেশে শিল্পায়নের পথ প্রশস্ত হবে। দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়লেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবহারের কারণে কৃষি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়েছে। অন্যদিকে শিল্পখাতে বিনিয়োগ, উৎপাদন, আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। লেখক : মহাব্যবস্থাপক জনসংযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ