‘শরীফ থেকে শরীফা’ একটি পর্যালোচনা
ড. বাবুল হোসেইন
একটি শিক্ষক সম্মেলনে আসিফ মাহতাব সপ্তম শ্রেণির একটি বইয়ের দুটি পাতা ছিড়ে প্রতিবাদ করলেন। সম্মেলনে উনার বক্তব্যের ভিডিও আমি দেখেছি। গল্পে যে বিষয়টি আলোকপাত করা হয়েছে তা হলো আমাদের সমাজে ‘তৃতীয় লিঙ্গের (যাদের আমরা হিজড়া বলি) সমস্যা, তাদের প্রতি সামাজিক ও রাষ্ট্রের অবহেলা। তাদের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব কেমন হওয়া উচিত এই বিষয়টি। গল্পটি পড়েছি আমি। আসিফ সাহেবের বক্তব্য দেখে বুঝতে পারলাম, উনি তৃতীয় লিঙ্গ দের সমস্যা আর সমকামীতা এই দুটো সমস্যাকে একাকার করে ফেলেছেন। উনার এই দুটো বিষয় নিয়ে আরো পড়াশোনা করা দরকার ছিল। আমরা এখানে তৃতীয় লিঙ্গ এবং সমকামীতা বুঝার চেষ্টা করতে পারি তৃতীয় লিঙ্গ কি? নারী পুরুষের বাইরে যাদের শরীরে উভয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, তাদের এই তৃতীয় শ্রেণিতে ফেলা হয়। এই বৈশিষ্ট্য জন্মের সময় ক্রোমোজোমের বিভাজনের অস্বাভাবিকতার কারণে হয়ে থাকে। দেখা যায়, জন্মের সময় লিঙ্গ দেখে মনে হয় ছেলে বা মেয়ে কিন্ত বড় হওয়ার সাথে সাথে ছেলের ভিতরে মেয়ের আচরণ দেখা দেয় বা মেয়ের ভিতরে ছেলের আচরণ দেখা দেয়। অর্থাৎ একই শরীরে ছেলে মেয়ে বৈশিষ্ট্য! মানব শরীরে ২৩ জোড়া ক্রোমোজম, এর এক জোড়া সেক্স ক্রোমোজম। এই এক জোড়া ছেলেদের ক্ষেত্রে ঢণ, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ঢঢ নামে থাকে। এই কথাগুলো মেডিকেল সায়েন্স থেকে বলছি। জন্মের সময় উভয় দিক থেকে একটি করে ক্রোমোজম এসে নতুন শিশুর ক্ষেত্রে আবার এক জোড়া সেক্স ক্রোমোজম হয়, যদি ঢঢ হয় তাহলে শিশু মেয়ে হয়, আর যদি ঢণ হয় তাহলে শিশু ছেলে হয়। ব্যতিক্রম আছে, অস্বাভাবিক ক্রোমোজম একত্রিত হতে পারে, তখন এমন হতে পারে ঢঢঢ, বা ঢঢণ মিলিত হয়ে অস্বাভাবিক কোষের জন্ম দেয়। এভাবেই তৃতীয় লিঙ্গের জন্ম হয়। আমাদের সমাজে এই তৃতীয় লিঙ্গ হিজড়া নামে পরিচিত, প্রকৃতপক্ষে হিজড়া হলো একটি সমাজ ব্যাবস্থা যেখানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ গুলো একত্রিত হয়ে বসবাস করে। সমকামীতা কি? এক কথায় এটা সামাজিক ভাবে অস্বাভাবিক যৌন আচরণ। যেখানে একই লিঙ্গের দুজন মানুষ যৌন আকর্ষণ বোধ করে,সম্পর্ক তৈরি করে। মেয়েরা মেয়েদের প্রতি আর ছেলেরা ছেলেদের প্রতি। মেয়েতে মেয়েতে হলে তাদের লেজবিয়ান বলে, ছেলেতে ছেলেতে হলে গে বলা হয়। সমকামীতার ব্যতিক্রমও আছে। কিছু আছে দ্বৈত যৌন জীবন। যেমন একজন পুরুষ বা নারী, নারী ও পুরুষ উভয়ের প্রতিই যৌন আকর্ষণ বোধ করে। প্রশ্ন হলো তৃতীয় লিঙ্গের যৌন আচরণ কেমন? এক কথায় বলা যায় মিশ্র যৌন আচরণ। অর্থাৎ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করতে পারে, আবার নারী বা পুরুষের প্রতিও যৌন আকর্ষণ বোধ করতে পারে। এখন আবার আসি আসিফ মাহতাবের কথায়। উনি অভিযোগ করেছেন, ‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্পে সমকামীতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। খুব গুরুতর অভিযোগ! কিন্ত উনি এই অভিযোগ কেমনে আনলেন আমার মাথায় আসে না। উনি তৃতীয় লিঙ্গ বুঝেনি, এদের সামাজিক সমস্যা, দু:খ কষ্ট, অভাব, অভিযোগ বুঝেননি। সমকামীতাও হয়তো ভালো বুঝেন না। রাগের মাথায় একটা ফিলোসোফিক বক্তৃতা দিলেন যেনো! যারা আমার লেখা পড়ছেন, তাদের প্রতি আহবান ‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্পটা পড়ুন। সাথে সাথে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের দু:খ কষ্ট, তাদের অভাব, তাদের অধিকার বুঝার চেষ্টা করুন। তাদের প্রতি সমাজ রাষ্ট্রের অবহেলা বুঝার চেষ্টা করুন। লেখক: সহকাররি অধ্যাপক রংপুর সরকারি কলেজ