কল্যাণরাষ্ট্রই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ মন্দির ও মসজিদ
মাসকাওয়াথ আহসান
ভারতের স্বাধীনতার প্রায় পরপরই সোমনাথ মন্দির সংস্কার করে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে এর শিলান্যাস করতে যাবার অনুরোধ জানালে তিনি রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, আমি দেশের যে উন্নয়ন কার্যক্রম চালাচ্ছি; সেগুলোই আমার কাছে মন্দিরের মতো। কংগ্রেস অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হলেও নেহেরুর চারপাশ ঘিরে ছিলেন প্র্যাকটিসিং হিন্দু নেতারা। অথচ নেহেরু নিজের মানুষ পরিচয়টিকে পরিচর্যা করেছিলেন আমৃত্যু। সে কারণেই তিনি ছিলেন দলছুট একজন। এই যে অন্ধকার দক্ষিণ এশিয়া; এখানে যারা নিজের মানুষ পরিচয়ের পরিচর্যা করে; তারাই একা হয়ে যায়। কারণ এখানে ইহজগতের নৈতিকতা ও সাম্যের সাধনা বেশিরভাগ মানুষই করে না। তারা মসজিদ আর মন্দিরে গিয়ে পরকালের সাধনা করে; অথচ ইহকালে অনৈতিকতা আর অসাম্যের নানা ইতিউতি তাদের। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্র সৃজনের মাঝ দিয়ে হিন্দু ও মুসলমান দুটি সম্প্রদায়ের মাঝে যে ক্ষত তৈরি হয়; সে ক্ষত না শুকাতেই কংগ্রেসের অন্য নেতারা সোমনাথের মন্দির সংস্কারে লেগে পড়েছিলেন। সেই মন্দির প্রেমিকদের মাঝখানে বসে দক্ষিণ এশীয় বাস্তবতাকে অস্বীকার করে নেহেরু অসাম্প্রদায়িক ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে আবুল কালাম আজাদ নেহেরুর এই স্বপ্নের সারথি হয়েছিলেন। আধুনিক ভারতের ইতিহাস তাই নেহেরু-আজাদের স্বপ্নযাত্রার বছরগুলো। নেহেরুর মৃত্যুর পরে তার স্বপ্নের আঙরাখা সরে গেলে ইন্দিরা গান্ধীকেও জনতুষ্টির লক্ষ্যে মন্দিরে গিয়ে পুজো-পার্বণে অংশ নিতে হয়েছে। কারণ হিন্দু-ভারত তখন উঁকি দিতে শুরু করেছে। রাজিব গান্ধী চেষ্টা করেছিলেন অসাম্প্রদায়িকতা চর্চা করতে। কিন্তু তাই কী হয়; এই অন্ধকার জনপদে কতোগুলো ধর্মীয় ফিকশান নিয়ে অনৈতিক জীবন-চর্যায় বুঁদ লোকেদের সারাক্ষণ নৈতিকতার মুখোশ পরতে হয় মসজিদ-মন্দিরে গিয়ে; সর্বত্র ধর্মীয় চিহ্ন প্রদর্শন করে।
এখানে অসাম্প্রদায়িক দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতিকবিতাকে জোর করে পুজোর ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। ধর্মটাকেই যে এলাকার লোক সংস্কৃতি বলে পরিচয় করিয়ে দেয়; সেখানে নেহেরুর স্বপ্ন একা হতে বাধ্য। আমি যেহেতু পারিবারিকভাবে মুসলমান; তাই জীবনের শুরু থেকেই ইসলাম ধর্মের কুসংস্কার ও কট্টর চিন্তাগুলোর নিয়ত সমালোচনা করেছি। আমার প্রায় সমস্ত লেখালেখির মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় ইসলামি কট্টরপন্থার তীব্র সমালোচনা। আমি আসলে একটি উদারচিন্তার সমাজ খুঁজছিলাম। যেখানে নজরুলের গান থাকবে, মির্জা গালিবের কবিতা থাকবে, জালালুদ্দিন রুমীর মানব দর্শন থাকবে। আমাদের লালন-হাসন রাজার সম্প্রীতি সংগীত থাকবে।
আমার সংস্কৃতি চর্যার রবীন্দ্রনাথ পুজোর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলবে, হারেরেরেরে আমায় ছেড়ে দেরে দেরে। ভারতে গুজরাটের কৃতি সন্তান নরেন্দ্র মোদি বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে; গুজরাটে মুসলমানদের মনের মসজিদ ভেঙ্গে ভারত বিজয়ের রথ যাত্রায় শামিল হলে; ২০১৪ সালে নেহেরুর স্বপ্নের আপাত: মৃত্যু হয়। গতকাল ফেসবুকে পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব আখতারকে নিয়ে ভারতীয় এক যুবক একটি অশ্লীল পোস্ট শেয়ার করলে; সেখানে কমেন্ট শাখায় হিন্দু ও মুসলমানদের ইংরেজিতে বাক্য বিনিময়ের শ্লীলতা দেখে দক্ষিণ এশিয়ার একটি এক্সরে রিপোর্ট আমি পেয়ে যাই। বিস্ময় জাগে, দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো আজো কল্যাণরাষ্ট্র হতে পারেনি; উন্নয়নের মিছে মায়ার আড়ালে দারিদ্র্যের অস্থিসার মিছিল, বেকারত্ব, অধিকারহীনতা, গণমাধ্যমের পরাধীনতা, ধনী-দরিদ্রের রেকর্ড ব্যবধান; আর তরুণ প্রজন্ম পড়ে রয়েছে তার ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের কাল্পনিক মোহমায়ায়। আমি বচসারত তরুণদের প্রোপিকগুলো দেখলাম; পাশে নাম না লিখে দিলে বোঝার উপায় নেই কে হিন্দু; কে মুসলমান। এই অন্ধকার দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ; তার আবার শ্রেষ্ঠত্ব কী। সবই তো একই ঝাড়ের বাঁশ; মন্তব্যের ভাষা ও শব্দের আয়নায় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান। ফেসবুক বাংলায় রামমন্দিরের উচ্ছ্বাস নিয়ে যে আইডিগুলো আজ জয় শ্রীরাম বলছে; মনে পড়ে, এরা সারাবছর প্রগতিশীলতার শিক্ষা দিয়ে বেড়ায় জনে জনে। মানে ওর জয় শ্রীরামও লাগবে, প্রগতিশীলতাও লাগবে। আধুনিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও লাগবে আবার সেই অনুষ্ঠানে পুজোর ঘটও লাগবে। এরা নিজেরা বারো মাসে তেরো পার্বণে পুজোর ঘট হাজির করবে ফেসবুকে; মুসলমানদের কারো ফেসবুকে ধর্মীয় আচার দেখলে তাকে এটা ওটা বলে সার্টিফিকেট দিয়ে আসবে; এ বড্ড মামা বাড়ির আবদার সংস্কৃতি। কট্টর চিন্তার মুসলমানদের চিনি বলে; শৈশব থেকে একটা দূরত্ব ছিলো।
কিন্তু কট্টর চিন্তার হিন্দুগুলো মোদী আগমনের আগে বড্ড প্রগতিশীল সেজে ছিলো বলে; মোদীর আগমনকে আমার কাছে বেশ প্রয়োজনীয় মনে হয়। নইলে হয়তো ভ্রান্ত-অধ্যাসে কাটাতে হতো সারাজীবন। এ ব্যাপারগুলো অবাংলা ফেসবুক অঞ্চলে নেই। সেখানে জয় শ্রীরামটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট মোদীভক্ত; নেহেরু ভক্ত বেঁচে আছে তার সেকুলার এনলাইটেনমেন্ট নিয়ে। অবাংলাভাষীদের ঠুঁটো প্রগতিশীলতার অভিনয়ের চিকন বুদ্ধি নেই বললেই চলে। রাম মন্দিরে নির্মাণে আমি খুশি। শিলান্যাসে আপ্লুত অতিথিদের দেখে; বলিউড তারকাদের মধ্যে কারা ধর্ম শিক্ষিত আর কারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সেটা বোঝার সুযোগ হলো। দিল্লি স্কুল অফ ড্রামা থেকে পাশ করা তেমন কাউকে দেখিনি সেখানে। যেদিন ভারত কল্যাণরাষ্ট্র হবে; সেদিন রামমন্দিরে আলো জ্বালানোর যোগ্য হবে সে; নয়তো এ আলো আলেয়া হয়ে রয়ে যাবে। আমি নেহেরুর স্বপ্ন বা ইউটোপিয়া যাই বলুন; তাতে আস্থাশীল; কল্যাণরাষ্ট্রই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ মন্দির ও মসজিদ। ফেসবুকে ২২-১-২০২৪ প্রকাশিত হয়েছে।