বীমা গ্রাহকেরা বীমা কোম্পানির কাছ থেকে যথাযথ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হন?
পিআর বিশ্বাস : সাধারণ মানুষ বিপদের সময় বীমা কোম্পানি থেকে আর্থিক সাহায্য পেতে বীমা প্রিমিয়াম প্রদান করে, কিন্তু অভিযোগ দেখায় যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বীমা গ্রাহকরা বীমা কোম্পানির কাছ থেকে যথাযথ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হন। অনেক ক্ষেত্রে এটি ঘটে যে পলিসি-ধারীরা তিন বা চার বছর পরে প্রিমিয়াম দিতে পারেন না। এই ধরনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ বীমা কোম্পানি তাদের ক্লায়েন্টদের একটি পয়সাও ফেরত দেয় না যা বীমা খাতে বড় ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম চলছে। লোকেরা যদি ব্যাংকে টাকা জমা করে, তারা যে কোনও সময় তা তুলতে পারে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বীমা কোম্পানির পলিসি-ধারীরা তাদের অর্থ ফেরত পেতে পারে না যখন এটির প্রয়োজন হয় বা পলিসির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্বল আর্থিক স্বাস্থ্য ও সুশাসনের অনুপস্থিতির কারণে বাংলাদেশে প্রায় ৩৩ শতাংশ জীবন বীমা দাবি নিষ্পত্তি হয়নি। এভাবেই বীমা খাতের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।
২০১৫-২০১৬ ও ২০১৭-২০১৮ সালে একটি নেতৃস্থানীয় পুরোনো বীমা কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন বেআইনিভাবে পুনর্বীমা চেক নগদ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) অবহিত করা হয়েছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩২টি জীবন বীমা কোম্পানির মোট ২,৭৬০ কোটি টাকার বীমা দাবির মধ্যে ৬৭% নিষ্পত্তি করেছে। বাকি ৯১৪ কোটি টাকার দাবি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। যদি কেউ একটি ডিপোজিট পেনশন স্কিম (ডিপিএস) খোলে, যখন পলিসিটি পরিপক্ক হবে তখন সে জমাকৃত অর্থের বিপরীতে দ্বিগুণ রিটার্ন পাবে এই ধরনের লোভনীয় অফারগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন বীমা কোম্পানি তাদের সঙ্গে ডিপিএস খুলতে লোকেদের প্রলুব্ধ করছে। যদিও নগরবাসী খুব কমই একটি বীমা কোম্পানিতে ডিপিএস খোলে, ঢাকার বাইরে বসবাসকারী লোকেরা সহজেই এই ডিলের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ফলস্বরূপ গ্রামাঞ্চলের হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ যারা হাতে-কলমে জীবনযাপন করে তাদের সঞ্চয় বিভিন্ন বীমা কোম্পানিতে জমা করে। যদিও কিছু লোক এই ধরনের স্কিমগুলো থেকে সুবিধা পান, তবে বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের সঞ্চয়গুলোও ফেরত পান না। চলমান কোভিড ১৯ মহামারী চলাকালীন অনেক লোক কিছু বীমা সংস্থা থেকে স্বাস্থ্য কভারেজও পাচ্ছেন না। কখনও কখনও আমানতকারীরা যদি নির্ধারিত সময়ের আগে তাদের স্কিম বন্ধ করতে চায়, বীমা কোম্পানিগুলো অবিশ্বাস্য পরিমাণ জরিমানা ফি নেয়। বীমা কোম্পানির এই ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের বেশিরভাগই মিডিয়ায় অপ্রকাশিত থাকে ও প্রতারণার কয়েকটি উদাহরণ লাইমলাইটে আসে। অভিযোগ রয়েছে যে কিছু বীমা কোম্পানি তাদের স্থানীয় এজেন্টদের কার্যক্রম যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করে না। ফলস্বরূপ প্রাথমিকভাবে তারা লোকেদের স্কিম খুলতে ও তাদের কোম্পানিতে টাকা জমা দিতে রাজি করান, কিন্তু কিছু বছর পরে তারা এলাকা থেকে দূরে চলে যায় ও তাদের অফিস রাতারাতি উধাও হয়ে যায়। প্রতারকরা অনেক স্বনামধন্য বীমা কোম্পানির নামে এই ধরনের কাজ করে, কিন্তু আমানতকারীদের আইনি নথি থাকা সত্ত্বেও সেই কোম্পানিগুলো তাদের আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণ দেয় না। যখন এই ধরনের ঘটনা ঘটে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে, যারা কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ সঞ্চয় করে, এটি তাদের ভবিষ্যতকে ধ্বংস করে দেয় তাদের হতাশ অবস্থায় ফেলে। বিভিন্ন বীমা কোম্পানির অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ মানুষ এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বীমা কোম্পানি বা সরকার কেউই এসব ঘটনা দেখছে না ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
আমানত পেনশন স্কিম (ডিপিএস) বাংলাদেশে বীমা কোম্পানিগুলোর একটি সাধারণ ও সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায়িক উপকরণ। আশ্চর্যজনক তথ্য হলো যে যদিও বিদ্যমান বীমা আইন বীমা কোম্পানিগুলোকে তাদের পলিসির তালিকায় ডিপিএস অন্তর্ভূক্ত করার অনুমতি দেয় না তবে প্রতিটি কোম্পানি বছরের পর বছর ধরে এটি অফার করে আসছে। ডিপিএস-এর মতো বাংলাদেশের অধিকাংশ বীমা কোম্পানি অধিক অর্থ উপার্জনের জন্য অন্যান্য অনেক অনৈতিক, অবৈধ ও প্রতারণামূলক উপায় অনুসরণ করে। কিছু বীমা কোম্পানি পলিসি-ধারকদের বা কখনও কখনও পলিসি ধারকদের নির্ভরশীলদের হয়রানি করে যখন তারা পলিসি-ধারকের মেয়াদ বা মৃত্যুর পরে তাদের প্রাপ্য অর্থ দাবি করে। কিছু বীমা কোম্পানি দাবিকৃত অর্থ ফেরত দিতে বিলম্ব করার জন্য বিভিন্ন অজুহাত দেখায়। কখনও কখনও বীমা কর্মকর্তারা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে কাক্সিক্ষত পরিমাণের চেয়ে কম অর্থ প্রদানের চেষ্টা করেন।
ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড.আশরাফ উদ্দিন দ্য এশিয়ান এইজকে বলেন, ‘আমরা সবসময়ই অল্প সময়ের মধ্যে বীমা দাবি নিষ্পত্তির জন্য সর্বোত্তম চেষ্টা করি। কখনও কখনও লোকেরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেয় না যার ফলে দাবি নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হয়। কোনো অসামঞ্জস্যতা জানালে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিই।’ পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিএম ইউসুফ আলী দ্য এশিয়ান এইজকে বলেন, ‘আমরা আমাদের গ্রাহকদের প্রতি অত্যন্ত নিবেদিত। আমরা আমাদের যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বীমা দাবি সমাধান করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করি।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ দ্য এশিয়ান এইজকে বলেন, ‘সরকার ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের উচিত বীমা খাতে সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা। ক্লায়েন্টদের দ্বারা বীমা দাবি পরীক্ষা করা উচিত ও দ্রুত সমাধান করা উচিত।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দ্য এশিয়ান এইজকে বলেন, ‘বিমা কোম্পানিসহ বাংলাদেশের আর্থিক খাতে প্রচুর বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি ও অনিয়ম চলছে। তবে সব বীমা কোম্পানিই দুর্নীতিগ্রস্ত তা বলা যাবে না। সরকারের উচিত বীমা কোম্পানিগুলোকে এই করোনা ভাইরাস মহামারী চলাকালীন অবিলম্বে জনগণকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসতে বলা। লেখক : দ্য এশিয়ান এইজ-এর একজন সিনিয়র স্টাফ কোরেসপন্ডেন্ট।
সূত্র : দি এশিয়ান এইজ। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ