ট্রান্সজেন্ডার বিতর্ক, বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলা দর্শনের শিক্ষক ও পাঠ্যবই
তানজিনা হোসেন তন্নী
[এক] প্রথমে এক্সপার্টাইজড মতামত দিয়ে শুরু করা যাক। দুনিয়াতে সেক্স তিনভাবে ডিফাইন করা যায়। ১. ক্রোমোজোমাল সেক্স-যা অনুযায়ী ৪৬এক্স ওয়াই যাদের আছে তারা পুরুষ, ৪৬এক্সএক্স যারা তারা নারী; ২. গোনাডাল সেক্স-যাদের শরীরে টেস্টিস বা শুক্রাশয় আছে তারা পুরুষ, যাদের ডিম্বাশয় বা ওভারি আছে তারা নারী, ৩. ফেনোটাইপিক সেক্স: যাদের বাহ্যিক জননাঙ্গ পুরুষদের মতো তারা পুরুষ, যাদের মেয়েদের মতো তারা নারী। কিন্তু এই স্বাভাবিকতার বাইরে আরও বহু রকম ও প্রকরণ আছে যা উঝউ ( উরংড়ৎফবৎ ড়ভ ংবীঁধষ ফরভভবৎবহঃরধঃরড়হ) নামে পরিচিত। যেমন কারও ফেনোটাইপ বাইরে থেকে নারীর মতো কিন্তু তার দেহে কোনো জরায়ু ডিম্বাশয় নেই। কারও ক্রোমোজোমই ত্রুটিযুক্ত, পিওর এক্সওয়াই নয় আবার এক্স এক্সও নয়। কেউ একটা মেয়ে হিসেবে সমাজে বড় হচ্ছে কিন্তু ক্রোমোজোমাল অ্যানালাইসিস করে দেখা গেলো সে আসলে এক্স ওয়াই। আমরা এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি প্রায়ই হই। পড়হমবহরঃধষ ধফৎবহধষ যুঢ়বৎঢ়ষধংরধ, অহফড়মবহ রহংবহংরঃরারঃু ংুহফৎড়সব সহ আরও নানা ধরনের সমস্যায় এমন হতে পারে। এবং এই মানুষগুলোকে জঙ্গলে বা বনবাসে পাঠিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা সমাজেই থাকে এবং বড় হয়। এক সময় অন্যদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পরিবার সমাজ ছেড়ে হিজড়া সমাজের অন্তর্ভূক্ত হয়। কেউ কেউ লেখাপড়া করে, ডিগ্রি নেয়, হোসনে আরা ম্যাডামের বা হোচিমিন ইসলামের মতো সফল হয় বা ফরেন সার্ভিসেও চাকরি করে। সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের শরীফ (যে আসলে শরীফা) এরকমই একজন নিদোর্ষ শিশু। তার সঙ্গে অন্য শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য এই চ্যাপ্টার। নর্থ সাউথের বা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিনগ্রহবাসী শিক্ষক ছাত্ররা তাদের চেনে না। তারা শরীফাদেরকে মানুষ নয় পশু মনে করে। আশা করি পরবর্তী প্রজন্ম এদের মতো স্টুপিড হবে না। তারা শরীফাদেরকে চিনবে এবং সংবেদনশীল আচরণ করবে।
[দুই] সেক্স ও জেন্ডার এক জিনিস নয়। সেক্স জিনিসটা মেডিকেলি বা বায়োলজিকালি ডিফাইন করা সম্ভব, জেন্ডার নয়। জেন্ডার তৈরি করে সমাজ, পরিপার্শ্ব। সামাজিক বিহেভিয়ারিয়ারাল প্যাটার্ন, এক্সপ্রেশন এবং আইডেন্টিটি জেন্ডার তৈরি করে। এখানে মনোজগতেরও একটা গভীর যোগাযোগ আছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকার পরও কেউ কেউ জেন্ডার ডিসফোরিয়াতে ভুগতে পারে। দেখা গেলো সে ফেনোটাইপিকালি বা ক্রোমোজোমালি পুরুষ কিন্তু তার জেন্ডার ক্যারেকটারিস্টিক নারীর মতো। সে মেয়েদের মতো ভাবতে বা কাজ করতে ভালোবাসে, মেয়ে নয় ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এরাও সমাজের অংশ, আমাদের আশপাশেই আছে, এদেরকেও ধরে ধরে আমাজনের জঙ্গলে পাঠাবার অবকাশ নেই। সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে অবশ্য এদের কথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। অবাক ব্যাপার, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাকি দর্শন পড়ান। শুনে বেকুব হয়ে গেলাম। জেন্ডার বিষয়ক ফিলোসফি আমার চেয়ে তার ভালো জানার কথা। কীভাবে সেক্স বিষয়টার চেয়ে সমাজে ইতিহাসে জেন্ডার বড় হয়ে উঠলো এই বিষয়ে একজন ফিলোসফির অধ্যাপক হিসেবে তিনি একটা লেকচার দিতে পারেন।
[তিন] এবার নন এক্সপারটাইজ কিছু কথা বলি। আমার ফেবু বন্ধুদের মধ্যে কাউকে কাউকে দেখছি লিখছেন ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টা ইসলামে নেই, তাই এসব কথাকে গ্রহণ করা অবশ্যই হারাম। বক্তব্য প্রদানকারীদের কেউ কেউ চিকিৎসকও। তারা না পড়েছেন সায়েন্স, না পড়েছেন ধর্ম। তাই জিরাফের গলায় আটকে গেছেন। আসুন দেখি ইসলাম ট্রান্সজেন্ডার এবং জেন্ডার বিষয়ে কী বলে? ক্লাসিকাল ইসলামিক ল বা রুলস চার ধরনের জেন্ডার বা লিঙ্গবৈশিষ্ট্যকে ডিফাইন করে। পুরুষ, নারী, ডিএসডি বা খুনসা এবং মুখাননাত। খুনসা বা ট্রান্সজেন্ডারকে আবার ইসলাম দুইটি সাব ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে। ওয়াদিহ বা খুনসা ঘায়ের এবং খুনসা মুসকিল। যখন বাহ্যিক জননাঙ্গ দিয়ে সেক্স ডিফাইন করা যাচ্ছে না তখন ইসলামে তাদের ‘মেলনেস’ বা ‘ফিমেলনেস’ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে ডিফাইন করার কথা বলা হয়েছে। আর মুখাননাত হলো জেন্ডার ডিসফোরিয়া। তার মানে এতোক্ষণ যা বললাম তার সবই ইসলামে অলরেডি গৃহীত এবং প্রপারলি ডিফাইন্ড। এমনকি ফিকহ শাস্ত্রে ট্রান্সজেন্ডারদের সম্পত্তির অধিকার, বিবাহের নিয়ম, নামাজ পড়ার নিয়ম, পর্দা সম্পর্কেও বিস্তারিত বলা আছে। তাই যারা বলছেন ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টি ইসলামে স্বীকৃত নয় তারা কিছু না জেনে বুঝেই বলছেন। এ বিষয়ে যারা আরও এক্সপার্ট তারা লিখলে বা বললে ভালো হতো। আমরা স্পষ্ট জানতে পারতাম। ওপরের বক্তব্যের সমর্থনে কমেন্টে একটা লিংক দেয়া হলো। এ ধরনের স্কলারলি আর্টিকেল আরও অনেকগুলো আছে। আগ্রহীরা পড়ে নেবেন।
[চার] এবার আসি মুসলিম দেশের কথায়। ট্রান্সজেন্ডারদের চিকিৎসা নিয়ে সব দেশেই বিতর্ক আছে। তবে মুসলিম দেশগুলোতে স্বাভাবিক ভাবেই বেশি। তবে অন্যরা আমাদের মতো তাদের উড়িয়ে দিয়ে বা বইএর পাতা ছেঁড়ার মতো উদ্ভট কাজে বসে নেই। তারা এ নিয়ে রিলিজিয়াস লিডারদের সঙ্গে বসে আইন-কানুন তৈরি করছে। ২০০৬ সালে মালয়েশিয়ার ফতোয়া কমিটি অফ ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ ইসলামিক রিলিজিয়াস এফয়ার্স কোনো কোনো ক্ষেত্রে জেন্ডার এসাইনমেন্ট সার্জাারি করা যাবে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছে। মিশরেরও নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে। আমাদের এসব হাস্যকর ও অপরিপক্ক আচরণের পরিবর্তে সমাজ, রাষ্ট্র উপযোগী একটা সুস্পষ্ট রুলস রেগুলেশন গড়ে তোলার সময় এসেছে এখন। সরকার ট্রান্সজেন্ডারদের সামাজিক ও আইনগত স্বীকৃতি দিয়েছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি এবং সম্পদ বন্টনে তাদের সম অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শরীফার মতো হিজড়া পল্লীতে না গিয়ে তারা কীভাবে পরিবারে ও সমাজে বড় হতে পারে সেই চেষ্টা করতে হবে। সবশেষে একটা কথা না বলে পারছি না। আমাদের কম শিক্ষিত কম আধুনিক পুরনো সমাজেও ট্রান্সজেন্ডারদের কেউ ঘৃণা করতো না (আমাদের দাদি-নানিরা স্নেহও করতেন তাদের, পারলে সাহায্য সহযোগিতা করতেন, ডেকে দুটো খেতে দিতেন), বর্তমানে পর পর নর্থ সাউথ আর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নব্য আধুনিক আর সু? শিক্ষিত ইংরেজি বলিয়ে ছাত্র শিক্ষকরা যা করছেন তাতে অবাক হবারও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি। এরা পোষা কুকুর বেড়াল নিয়ে আদিখ্যেতা করে আর তৃতীয় লিঙ্গ হওয়ায় একজন মানুষকে ঘৃণা করে। এই শিক্ষাক্রমের আগে যে শিক্ষাক্রম ছিলো এরা তো তারই প্রোডাক্ট। আমার আর কিছু বলবার নেই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ। ফেসবুক থেকে