কে ঘষে আলাদিনের চেরাগ কে দেয় খেসারত
কল্লোল মোস্তফা
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে গত ৪ আগস্ট এস আলম’স আলাদিন’স ল্যাম্প (এস আলমের আলাদিনের চেরাগ) শিরোনামে একটি অনুসন্ধানি প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপ এসআলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম গত এক দশকে সিঙ্গাপুরে অন্তত দুটি হোটেল, দুটি বাড়ি, একটি বাণিজ্যিক স্পেস সহ বিভিন্ন সম্পদ কিনেছেন।
এই সম্পদগুলো ক্রয় করবার জন্য যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন তা বাংলাদেশ থেকে বৈধ ভাবে নিয়ে যাওয়া হয়নি কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত যে ১৭ টি কোম্পানিকে বিদেশে বিনিয়োগের জন্য বিদেশে নেয়ার অনুমোদন দিয়েছে তার মধ্যে এসআলম গ্রুপের নাম নেই। শুধু তাই না এসআলম সিঙ্গাপুরের সম্পত্তিগুলো কিনতে যে পরিমাণ ডলার খরচ করেছেন, তা ১৭টি কোম্পানিকে বৈধভাবে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দেয়া অর্থের (৪০.১৫ মিলিয়ন ডলার) চেয়ে বহুগুণ বেশি।
এর মধ্যে ৩২৮ কক্ষের হোটেল গ্র্যান্ড চ্যান্সেলর ১৭৭ মিলিয়ন ডলার, হোটেল ইবিস নভেনা ১২৫.৬ মিলিয়ন ডলার, ১৯ তলা সেন্ট্রিয়াম স্কয়ারে ২৭ হাজার বর্গফুট রিটেইল স্পেস ১০০.৫৩ মিলিয়ন ডলারে ক্রয় করা হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ ডলার বিদেশে পাচার করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে কতগুলো শেল কোম্পানি যার মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুরের ক্যানালি লজিস্টিকস ও উইলকিনসন ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের পিকক প্রপার্টি লিমিটেড, সাইপ্রাসের অ্যাকলেয়ার ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ইত্যাদি।
এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ইসলামি ব্যাংক সহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ লুন্ঠন বিষয়ে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তার সাথে বিদেশে অর্থ পাচার করে সম্পত্তি ক্রয়ের এইসব ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। ৩০ নভেম্বর ২০২২ এ ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ এ প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, এস আলম গ্রুপ ঋণের নামে তাদের মালিকানাধীন ইসলামি ব্যাংক থেকে অবৈধভাবে ৩০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো, এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ৫টি ইসলামি ব্যাংক তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছে এবং এই ব্যাংকগুলোর চলতি হিসেবের ঘাটতি মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক রীতিমত টাকা ছাপিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ধার দিচ্ছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এস আলমের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন অনিয়ম ও বিদেশে অর্থ পাচার নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের দ্বায়িত্ব ছিল নিজ উদ্যোগে সেইসব অভিযোগের তদন্ত করে বিচার করা ও পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া। সরকার সেটা করছে না। শুধু তাই না, একজন আইনজীবি এ বিষয়ে হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষন করলে ৬ আগস্ট ২০২৩ হাইকোর্ট স্বত: প্রণোদিত হয়ে তদন্তের নির্দেশ দিলে সেটাও আপিল বিভাগে স্থগিত হয়ে যায়। সেই স্থগিতাদেশ প্রথমে ৮ জানুয়ারি, এরপর ১৫ জানুয়ারি এবং সর্বশেষ ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বর্ধিত হয়েছে। (অভিযোগ অনুসন্ধানের বিরুদ্ধে এস আলমের আবেদনের শুনানি মুলতবি, প্রথম আলো, ১৫ জানুয়ারি ২০২৪)
প্রশ্ন হলো, অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের তদন্তের জন্য আবার শুনানি লাগবে কেন? দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারের খবর প্রকাশিত হলে তদন্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। তদন্তে প্রাথমিক ভাবে দোষী পাওয়া গেলে তারপর বিচার। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করবার জন্য আদালতে শুনানি হতে হবে কেন? আদালতই বা কোন যুক্তিতে তদন্ত কাজে স্থগিতাদেশ দেয়? দেশে আইনের শাসন, আইন সবার জন্য সমান- এইজাতীয় যেসব কথাবার্তা বলা হয় তা যে কত অন্ত:সারশুন্য, এই ধরণের ঘটনার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায়।
সাধারণত অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুন্ঠনের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য বিদেশে পাচার করা হয়। দেশে ক্রমাগত অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুণ্ঠন হচ্ছে বলেই দেশের বাইরে ডলার পাচার হচ্ছে। আর ডলার পাচার হচ্ছে বলেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অস্বাভাবিক হারে কমছে। আবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট হচ্ছে বলে জ্বালানি সহ বিভিন্ন পণ্য ও কাচামাল আমদানির এলসি খোলা কমিয়ে দিতে হয়েছে যা রপ্তানিখাতসহ দেশের অর্থনীতির উপর চাপ তৈরী করছে।
আরব্য রজনীর গল্পের দরিদ্র ছেলে আলাদিন জাদুর চেরাগ ব্যবহার করে ধনী হওয়ার পথে কাউকে লুণ্ঠন করেনি। কিন্তু এস আলমের মতো ব্যবসায়ীরা যখন ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির জাদু-চেরাগ ব্যবহার করে বিদেশে ডলার পাচার করে তখন দেশের কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যত বিপন্ন হয়। লেখক: সর্বজন কথার নির্বাহী সম্পাদক। ফেসবুক পোস্ট।