বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা : স্বাধীনতার আগে ও পরে
আবু মো. জাকির হোসেন : মহামারী রোগে অসুস্থতা ও মৃত্যুর উচ্চ হার ১৮৫৭ সাল থেকে ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছিলো। ১৮৫৭ সালের পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে মোট মৃত্যুর সংখ্যার মধ্যে ৯৪ শতাংশের কারণ ছিলো চারটি প্রধান রোগ – জ্বর, আমাশয়, ডায়রিয়া, লিভারের রোগ ও কলেরা। টিকাদার নামক কর্মীদের মাধ্যমে গুটিবসন্তের টিকা দেওয়ার জন্য ডিসপেনসারীগুলোও ছিলো। ১৮৮১ সালের শুরুতে গ্রামীণ ও আধা-শহর এলাকায় জেলা বোর্ডগুলো স্থাপন করা হয়েছিলো, যেগুলোকে অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ড্রেনেজ, জল সরবরাহ, সাধারণ স্যানিটেশন, হাসপাতাল ও দাতব্য চিকিৎসালয়গুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিজস্ব সম্পদ সংগ্রহ করতে হয়েছিলো। পৌরসভাগুলো অপ্রশিক্ষিত স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও ভ্যাক্সিনেটর নিয়োগ করেছে। বাংলায় দাতব্য চিকিৎসালয়ের মোট সংখ্যা ১৮৬৭ সালে ৬১টি থেকে ৩৭ বছরে অর্থাৎ ১৯০০ সালের মধ্যে বেড়ে ৫০০-এর বেশি হয়। বাংলা সরকার গ্রাম পর্যায়ে পুরুষ কবিরাজ, ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসকদের নিয়োগ করেছিলো। ১৯০৭ সাল থেকে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের মহাপরিচালক সারা ভারতে জেলাগুলোর কমিশনারদের মাধ্যমে জেলা বোর্ডগুলোকে বৈধ, আর একজন আদিবাসী চিকিৎসা পেশাজীবী, হাকীম, মুসলিম চিকিৎসা পেশাজীবীদের নিয়োগের অনুমতি দেওয়ার জন্য কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রশিক্ষিত জনস্বাস্থ্য কর্মীরা ১৯১৯ সাল থেকে বোর্ড ও পৌরসভা দ্বারা ভারতের অধিকাংশ প্রদেশের গ্রামীণ ও শহুরে এলাকায় নিয়োগ করা হয়েছে। বেঙ্গল ভিলেজ সেল্ফ-গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট ১৯১৯ গ্রামীণ এলাকায় জনস্বাস্থ্যের জন্য স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তরে ইউনিয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করে।
বাংলায় জনস্বাস্থ্য শিক্ষা : কলকাতা মেডিকেল কলেজের অধীনে ১৯১৪ সালে ক্যালকাটা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কলেজটি ১৮৩৫ সালে মেডিক্যাল কলেজ, বেঙ্গল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। মেডিকেল কলেজ হিসেবে এটি ভারতের ইকোলে দে মেডিসিন ডি পন্ডিচেরির পরে এশিয়াতে পাশ্চাত্য চিকিৎসা শেখানোর জন্য দ্বিতীয় প্রাচীনতম। কালাজ্বরের প্রাথমিক চিকিৎসার উদ্ভাবক ইউএন ব্রহ্মচারী, কুষ্ঠরোগের প্রাথমিক চিকিৎসার উদ্ভাবক আর্নেস্ট মুইর ও ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট আবিষ্কারকারী রোনাল্ড রসের মতো বিশিষ্ট গবেষকরা এই বিদ্যালয়ে কাজ করেছেন। পাকিস্তানে চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা : একটি ‘অল পাকিস্তান হেলথ কনফারেন্স’, দ্বিতীয়টি, পাকিস্তানের অস্তিত্বের পর ১৯৫১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে স্বাস্থ্য খাতের ছয় বছর মেয়াদী পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়। এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি, গ্রামের ডিসপেনসারির সংখ্যা, মেডিকেল স্কুলগুলোকে মেডিকেল কলেজে রূপান্তর করা, ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড প্রিভেন্টিভ মেডিসিন (নিপসম নয়), মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা। ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি, পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের প্রতিটিতে একটি করে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা স্বাধীন বাংলাদেশ একটি হচ্ছে, প্রতিরোধমূলক ও নিরাময়কারী ওষুধের সমন্বয়কদের মোতায়েন ও ম্যালেরিয়া নির্মূল কেন্দ্র স্থাপন।
এছাড়া ম্যালেরিয়া ও গুটিবসন্ত নির্মূল কার্যক্রম, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিসিজি টিকাদান ইত্যাদি ও জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম তত্ত্বাবধান ও বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পূর্ববর্তী জেলা বোর্ডগুলো, ব্রিটিশ রাজের উত্তরাধিকার, পাকিস্তানে এখনও কার্যকর ছিলো। তারা প্রতিটি জেলায় একজন করে জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিয়োগ করতেন যারা মূলত রোগ প্রতিরোধে কাজ করতেন। জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কার্যক্রম জেলা বোর্ড ও জনস্বাস্থ্য পরিচালকের দ্বৈত নিয়ন্ত্রণে থাকতো, ব্রিটিশ আমলে একটি পদ তৈরি হয়েছিলো যখন নিরাময়মূলক চিকিৎসা পরিষেবা সার্জন জেনারেলের দায়িত্ব ছিলো। পাকিস্তান কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস-এ ক্লিনিকাল বিষয়ে ফেলোশিপের জন্য এন্ট্রি পরীক্ষার যোগ্যতা অর্জন করতে, একজন মেডিকেল স্নাতককে স্নাতকের পর কমপক্ষে দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে ও একটি অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে দুই বছরের কোর্স করতে হবে, যার মধ্যে এক বছর বেসিক সাবজেক্ট যেমন ফিজিওলজি, প্যাথলজি, মাইক্রোবায়োলজি প্রভৃতি পড়ার জন্য ও দ্বিতীয় বছর স্পেশালাইজেশন বিষয়ের অধ্যয়নের জন্য ব্যয় করতে হয়।
একইভাবে গ্রীষ্মমন্ডলীয় ওষুধ ও জনস্বাস্থ্যের ফেলোশিপ কোর্সটি দুই বছরের কোর্স করার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। কলেজ ফর ক্লিনিকাল মেডিসিনের প্রয়োজন অনুসারে প্রথম বছরটি মূলত মৌলিক বিষয়গুলোর অধ্যয়নের জন্য ব্যয় করা হয়েছিলো। মহামারীবিদ্যা, জীব পরিসংখ্যান, পেশাগত স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় অধ্যয়নের জন্য সময় বরাদ্দ করা হয়েছিলো। দ্বিতীয় বর্ষে ছাত্রদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ছিলো যে তারা ক্রান্তীয় অঞ্চলে বিশেষ আগ্রহের বিষয় যেমন সংক্রামক রোগ, পুষ্টিজনিত ব্যাধি ইত্যাদি প্রতিরোধমূলক ও সমস্যাটির প্রাসঙ্গিক সম্প্রদায়ের দিকগুলোর উপর বিশেষ জোর দিয়ে ওষুধের এমন ক্ষেত্রগুলো অধ্যয়ন করবে।
‘অতএব অবশ্যই, মূলত ক্রান্তীয় অঞ্চল ও জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ওষুধের মিশ্রণ ছিলো। সেই প্রারম্ভিক বছরগুলোতে সমস্ত বিষয়ের জন্য পূর্ণ-সময়ের শিক্ষক পাওয়া একটি মারাত্মক সমস্যা ছিলো। প্রাপ্য ছাত্র ও অল্প বয়স্ক শিক্ষকদেরকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছিলো স্কুলে সিনিয়র শিক্ষক পদ পূরণের জন্য। স্কুলের অধীনে সংগঠিত মৌলিক বিষয়গুলোতে এমফিল ও পিএইচডির মতো উন্নত কোর্সের প্রস্তাবও কল্পনা করা হয়েছিলো। ঢাকায় দ্বিতীয় রাজধানী এলাকায় ২০০ শয্যার সংযুক্ত হাসপাতাল সহ স্কুলটির একটি স্থায়ী ভবন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। স্কুলটি ক্লিনিকাল কাজের জন্য সংক্রামক রোগ হাসপাতাল মহাখালী ব্যবহার করতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ও আগ্রহী শিক্ষার্থীদের অভাবের কারণে, দুই বছরের ক্রান্তীয় ওষুধ ও জনস্বাস্থ্য কোর্স বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য শিক্ষা, সেবা : ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর, সরকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি ও ওষুধের সঙ্গে সম্পর্কিত পর্যাপ্ত মানব সম্পদের বিকাশের দিকে মনোনিবেশ করেছিলো। ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের বিভিন্ন শাখায় উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত স্নাতকোত্তর মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট স্বাধীনতার পর এপিডেমিওলজি বিভাগও তৈরি করে।
যদিও ইতিমধ্যে এই ধরনের একটি বিভাগ থাকা সত্ত্বেও এটি শিশুরোগ বিভাগের একটি অতিরিক্ত বিভাগে রূপান্তরিত হয়েছিলো। ১৯৭২ সালে মিটফোর্ড হাসপাতাল স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়। একই সময়ে, বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস পুন:প্রতিষ্ঠিত হয় ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল সংস্কার করা হয়। এছাড়াও ন্যাশনাল হেলথ লাইব্রেরি ও ডকুমেন্টেশন সেন্টার হালনাগাদ ও আধুনিকীকরণ করা হয়েছে।
লেখক : সাবেক পরিচালক, প্রাইমারি হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ডিজিজ কন্ট্রোল, আইইডিসিআর, ডিজিএইচএস এর প্রাক্তন ডিরেক্টর, এসইআরও, ডব্লিউএইচও এর প্রাক্তন আঞ্চলিক উপদেষ্টা ও প্রাক্তন স্টাফ কনসালটেন্ট, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, বাংলাদেশ। সূত্র : নিউএজ। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ