নতুন সরকারের জন্য তিন প্রধান চ্যালেঞ্জ
মীর মোশাররফ হোসেন পাকবীর : ৭ জানুয়ারি, বাংলাদেশের ১২ তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, একটি নতুন সরকার গঠন করে। ১০ জানুয়ারি নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নেন। ১১ জানুয়ারি, বিজয়ী আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা যথাক্রমে পঞ্চম ও চতুর্থ মেয়াদে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের ইতিমধ্যেই মনোনীত ও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমরা বাংলাদেশের নবনির্বাচিত সরকারকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাই ও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী যে তার নির্দেশনায় সমৃদ্ধি ও বিকাশ অব্যাহত রাখবে। নতুন সরকারকে পূর্ববর্তী মেয়াদে করা তাদের সমস্ত ভালো কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অবিলম্বে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। প্রথম সমস্যা যা আগত প্রশাসনকে এখনই মোকাবেলা করতে হবে তা হলো অর্থনৈতিক বা আর্থিক ব্যবস্থাপনা। প্রায় প্রতিটি অর্থনৈতিক সূচক তীব্রভাবে হ্রাস পেয়েছে। নতুন সরকার এখন অর্থনীতিকে পাথরের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য একটি কঠিন কাজের মুখোমুখি। বৈশ্বিক সংকট ও সরকারের ত্রুটিপূর্ণ নীতি উভয়ের কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার এখন তার পঞ্চম মেয়াদে জটিলতার দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। প্রথমে সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। রিজার্ভের পতন বন্ধ করা ও ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল করা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
অর্থনীতির বৃদ্ধির গতিপথকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ। এ জন্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। অর্থবছরের প্রথমার্ধ এখন শেষ। শেষ হতে বাকি ছয় মাস। এই ছয় মাসে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা সরকারের জন্য আরেকটি কাজ হবে। এই বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য কোনো আদর্শ, প্রচলিত উপায় থাকবে না। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন আগামী বাজেট পর্যন্ত বিশেষ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে কারণ তা উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি খাতের জন্য একটি ভালো বার্তা দেবে। দেশের ব্যাংকিং খাত অর্থ পাচার ও আত্মসাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি অপ্রতুল। ব্যাংকিং শিল্পের উপর মেঘ তুলে নিতে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে মোকাবেলা করা নতুন সরকারের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ হবে। ব্যাংকিং শিল্পের তত্ত্বাবধানের জন্য একটি কমিশনের প্রয়োজন ও এই সংস্থাটিকে তার দায়িত্ব পালনের জন্য সীমাহীন কর্তৃত্ব দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতিবিদরাও বিশ্বাস করেন যে বেশ কয়েকটি খাতে উন্নতি প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে সরকারের ঋণ গ্রহণ নিয়ন্ত্রণে রাখা, সরকারি ব্যয়ের গুণমান বাড়ানো, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল করা, শেয়ার বাজারের উন্মুক্ততা বজায় রাখা ইত্যাদি। নতুন অর্থমন্ত্রী হলেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর প্রাথমিক অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নের দায়িত্বে ছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব কার্যকরভাবে পালন করা এখন অপরিহার্য। বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান বাধা হলো জবাবদিহিতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা।
নাগরিকদের বিনিয়োগ বা তাদের অর্থ অভ্যন্তরীণভাবে রাখার আহ্বান জানাতে নবনিযুক্ত অর্থমন্ত্রীকে কয়েকটি ব্যবস্থা নিতে হবে। এমনকি যদি নিঃসন্দেহে অবৈধ অর্থের স্রোত থাকবে, কিছু লোক ইতিমধ্যেই এর কিছু অংশ অধিগ্রহণ করেছে ও যদি এটি ঠিক হয়ে যায় তবে এটি আমাদের উপকৃত করবে। অতএব কিছু কিছু খাত যেখানে লোকেরা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তাদের অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে নতুন প্রশাসনের দ্বারা চালু করা উচিত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে আজকের এই ব্যবস্থা জরুরি। নতুন অর্থমন্ত্রীকে এমন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে যা ঋণ পরিশোধের নীতি ও সুদকে অগ্রাধিকার দেয় যা বাংলাদেশ গত ১৫ বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নিয়েছে। বাংলাদেশ একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক অসুবিধাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে যদি আমাদের সিস্টেমে দুর্নীতি দমন করা হয়। মূল্যস্ফীতির উচ্চহার নিয়ন্ত্রণ করা দ্বিতীয় প্রধান কাজ যা নতুন প্রশাসনকে নিতে হবে। এটি নবগঠিত সরকারগুলোর শীর্ষ অগ্রাধিকার হওয়া দরকার। নতুন প্রশাসনকে শিল্প ও কৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনৈতিক ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। কৃষি উৎপাদন বাড়লে দ্রব্যমূল্য বাড়বে না। বাজার মনিটরিং বাড়ানো ও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এটি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ যে আমদানি বা খুচরা সিন্ডিকেট নেই। আমরা সচেতন যে অনেক ব্যবসার মালিক হতে পারে না যারা সক্রিয়ভাবে মূল্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। সমগ্র আমদানি বাজার একটি অলিগোপলি, যার অর্থ হলো অল্প সংখ্যক কর্পোরেট সংস্থা সমস্ত দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ও প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য নির্ধারণ করতে সক্ষম। তাই তারা সৎ হলেও, খুচরা বিক্রেতা সহ অন্যান্য ডিলারদের বেশিরভাগই অতিরিক্ত উচ্চ হারে পণ্য সরবরাহ করতে বাধ্য হয়। এটা অসম্ভব বলে মনে হয় যে সরকার এই অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ ও এটা অবিশ্বাস্য যে এই বিশেষ স্বার্থ সরকারকে শক্তিতে ছাড়িয়ে গেছে। এটা প্রত্যাশিত যে সরকার শুধু বাজারের দিকে নজর না রেখে সমস্যা সমাধানে একটি সামগ্রিক পন্থা অবলম্বন করবে।
সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে পণ্যের দাম সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একটি আরও প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করতে ও অল্প সংখ্যক লোকের দ্বারা মূল্যের কারসাজির দীর্ঘমেয়াদী সমাধান তৈরি করতে, ব্যবসা-বাণিজ্যের অলিগোপলিগুলো ভেঙে ফেলা উচিত। শক্তিশালী ভোক্তা সমিতিগুলোও গুরুত্বপূর্ণ কারণ তারা নির্বিচারে মূল্য বৃদ্ধি ও ভোক্তা অধিকারের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে অ্যাডভোকেসি গ্রুপ হিসেবে কাজ করতে পারে। জনগণের জন্য শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য আনতে সরকার কর্তৃক ‘রেশন কার্ড’ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা উচিত। উদ্দীপনাকে নির্বাচিত কয়েকজনের জন্য সুযোগ করে দেওয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত সরাসরি জনগণের কাছে এটি সরবরাহ করা। রেশনিং ব্যবস্থায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের অন্তর্ভূক্ত করতে পারলে নতুন প্রশাসন খুবই সফল হবে। সরকারের তৃতীয় জরুরি অগ্রাধিকার হলো সকল উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশ যারা ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির পাশাপাশি অতীত প্রশাসন ও নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে। বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্থানীয় ও বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব পেয়েছে। তদ্ব্যতীত পৃথিবী আবার দ্বিমেরুত্বের দিকে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ নতুন বাংলাদেশি সরকারের সবার সঙ্গে তার মিথস্ক্রিয়ায় ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হবে।
সমস্ত বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ দেশের অভ্যন্তরে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অনেকাংশে এর উপর নির্ভর করে। দুর্ভাগ্যবশত অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ছাড়াও পশ্চিমারা নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক ও চরমপন্থী দুর্বলতা তৈরি করেছে ও বাংলাদেশ সে ঝুঁকি নিতে পারে না। যেকোনো প্রতিকূলতা ও অনিশ্চয়তা থেকে আমাদের জনগণকে রক্ষা করতে আগামী বছরগুলোতে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে সম্পূর্ণ স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। তাই নতুন সরকারকে আমাদের সকল উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। নবগঠিত সরকার তার মন্ত্রিসভায় অনেক পরিবর্তন গ্রহণ করেছে। নতুন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের ওপর আস্থা রাখার পাশাপাশি অতীতের পারফরম্যান্স বিবেচনা করে মন্ত্রিসভা সংস্কার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এই পদগুলো একটি বার্ষিক পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে যেতে হবে ও যদি কোনও মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে অক্ষম হন তবে তাকে আরও দক্ষ কাউকে দিয়ে প্রতিস্থাপন করা উচিত। মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের রাজনৈতিক বক্তৃতা বা আলগা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে হবে কারণ এটি সরকারকে অকেজো চাপের মধ্যে রাখে ও পাশাপাশি কাজ থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়, নতুন মন্ত্রিসভাকে অবশ্যই তাদের সমস্ত ফোকাস কঠোরভাবে কাজে লাগাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত তিন মেয়াদে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন। অতীতে তার সরকার কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীনও সমস্ত অর্থনৈতিক সূচকে উন্নতি করতে সফল হয়েছিলো। উস্কানি সত্ত্বেও তার সরকার তার সমস্ত বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে একটি শক্তিশালী অংশীদারিত্ব বজায় রেখেছে। একটি ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা বিশ্বাস করি তার সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধেও জয়ী হতে পারে কারণ এটি জনগণের জন্য শান্তি আনবে। তাই আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে নতুন সরকার উল্লিখিত সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পূর্ণ সক্ষমতা রাখে। আমরা নতুন সরকারের ওপর আস্থা রাখি ও আশা করি বাংলাদেশ উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও সম্মানের শিখরে এগিয়ে যাবে।
লেখক : মোহাম্মদী নিউজ এজেন্সির (এমএনএ) প্রধান সম্পাদক ও কিশোর বাংলার সম্পাদক।
সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার।
অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ