রমজান সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা সক্রিয় থাকায় কারণ ছাড়াই বাড়ছে চিনি আদা রসুন ছোলা ডাল চাল মাংস সবজির
মাসুদ মিয়া: [১] রাজধানীসহ সারাদেশে অধিকাংশ নিত্যপণ্যের বাড়তি থাকায় সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। এদিকে ক্রেতারা অভিযোগ করে বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পর থেকে রমজান মাসকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা সক্রিয় থাকায় কারণ ছাড়াই বাড়ছে অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম। রোজা আসতে এখনো বাকি দেড় মাসের বেশি সময়। তবে এখনই বাজারে দাম বাড়ার তালিকায় সবার ওপরে রোজায় বেশি প্রয়োজন হয় এমন পণ্যের। বাজারে এখন ছোলা, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, আদা, রসুন ও পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। [২] গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।
ক্রেতারা বলছেন, রমজানকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীচক্র পুরোনো ছক কাজে লাগাচ্ছে। রমজাননির্ভর পণ্যের দাম তারা আগেই বাড়িয়ে নিচ্ছে। তাতে রমজানে নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না। একই সঙ্গে দীর্ঘ সময় ভোক্তার পকেট কেটে অতিরিক্ত মুনাফা করা যায়। এবিষয়ে মতিঝিল কোলনী বাজারে কথা হয় সাইফুল ইসলাম নামের এক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রমজানের সময় প্রশাসনের তোড়জোড় বেশি থাকে বাজারে। সেজন্য এরা (ব্যবসায়ীরা) এখন বাড়িয়ে রাখছেন, যেন ওই সময় আর না বাড়াতে হয়। তাতে এখনো লাভ, তখনো লাভ।
[৩] এদিকে, বাজারে চালসহ সব ধরনের সবজি ও অন্যান্য বেশকিছু খাদ্যপণ্যও বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। নির্বাচনের পরে প্রতি কেজি চালের দাম ৫ টাকা থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছিল। এখনো সে দাম স্বাভাবিক হয়নি। কিছু দোকানে ২ থেকে ৩ টাকা কমতে দেখা গেছে। তবে বেশিরভাগ দোকানে বিক্রি হচ্ছে আগের দামেই।
[৪]এদিকে বাজারে শীতকালীন সবজির সরবরাহ ভালো থাকার পরও দাম বাড়তি। প্রতিকেজি বাজারে পেঁপে, মুলা আলু ছাড়া অধিকাংশ সবজি ৮০ টাকার ওপরেই বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া রসুনের দাম ২০ থেকে ৪০ টাকা এবং আদা ১০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। আদা ও রসুন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া ৮০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ এখন ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় পেঁয়াজ এখনো বেশ বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে।
[৫] সূত্র জানায়, রমজানকে ঘিরে সরকারের একাধিক সংস্থা বাজার তদারকিতে নেমেছে। তারা মোকাম থেকে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে তদারকি করছে।তবে সবচেয়ে অস্থিতিশীল রমজানের অন্যতম পণ্য ছোলার বাজার। গতবছর প্রতি কেজি ছোলা মানভেদে বিক্রি হয়েছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, যা এক মাস আগেও একই দাম দেখা গেছে। ওই ছোলা এখন ১০০ থেকে ১১০ টাকায় উঠেছে। [৬] একইভাবে প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম ১০ টাকা বেড়ে ছোট দানার মসুর ডাল ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভালো মানের মুগ ডালের কেজি হয়েছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ১৫০ টাকার মধ্যে ছিল। একইভাবে অ্যাংকর ডালের দামও বেড়েছে। নতুন করে বেড়েছে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম। প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা দরে, যা গত সপ্তাহের থেকে ১০ টাকা বেশি। বোতলজাত ভোজ্যতেলের দাম গত সপ্তাহে প্রতি লিটারে ৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এরপর থেকে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বাড়ছে। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা এবং পাম তেল ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। আগের সপ্তাহের তুলনায় যা ৫ টাকা বেশি। এছাড়া প্রতি কেজি খোলা চিনি এলাকা ভেদে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। যা এ যাবৎকালের সবোর্চ্চ।
[৭] পাঁচ ভাইঘাটলেন বাজারের মুদি দোকানি নাজমুল বলেন, ‘ছোলা, ভোজ্যতেল, ডালের মূল্য মোকাম পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে। ফলে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বেড়েছে। একেক পণ্যের দাম একেক অজুহাতে বেড়েছে। কিন্তু কোনোকিছুর দাম কমেনি। এদেশে আর কিছু কমে না, শুধু বাড়ে।
[৮]এদিকে, কিছুদিন দাম একটু কমলেও ফের বেড়েছে গরুর মাংসের দাম। বাজারে এখন গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায়। এছাড়া ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা। এদিকে মাছের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চাষের পাঙাস-তেলাপিয়া থেকে শুরু করে দেশি প্রজাতির সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে। আগে বাজারে প্রতি কেজি পাঙাস বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়। অন্যদিকে তেলাপিয়া মাছের কেজি হয়েছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, যা আগে ১৮০-২০০ টাকায় কেনা যেতো। বাজারে সাধারণত গরিব ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রেতারা ব্রয়লার মুরগি এবং পাঙাস- তেলাপিয়া মাছের পরে বেশি নির্ভরশীল। তাদের মধ্যে অনেকে এসব নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। [৯] মতিঝিল বাজারে মাছ বিক্রেতারা জানান, প্রতি কেজি চিংড়ি বিক্রি করছেন ৬০০-১০০০ টাকায়। যা আগে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে বিক্রি করতেন। অন্যান্য চাষের মাছগুলোও বেশ বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তাজা রুই, কাতলা, মৃগেল বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩৬০ টাকা কেজিতে, যা আগে ২৫০ থেকে ৩২০ টাকা ছিল।
[১০] এদিকে লক্ষিবাজারে এক ক্রেতা বেসরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ‘আমার বেতন এ বছরের শুরুতে যা ছিল এখনো তাই আছে। এক টাকাও বাড়েনি। কিন্তু প্রায় সবকিছুরই দাম বেড়ে যাওয়ায় আমার মাসিক খরচ অন্তত ৫ হাজার টাকা বেড়েছে। এই বাড়তি খরচের বোঝা টানতে গিয়ে সবকিছুর মধ্যে সমন্বয় করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এমন কিছু খরচ আছে যেগুলো কমানোর উপায় নেই। যেমন- গাড়ি ভাড়া, বাচ্চার খাবার, বাসা ভাড়া বেতন এসব কমানোর তো উপায় নেই। কাজেই যেখানে খরচ কমানো সম্ভব সেখানে কমানোর চেষ্টা করছি। আগে খাবারে ৪ থেকে ৫ পদের তরকারি থাকতো, এখন সেটা ২ থেকে ৩ পদে নামিয়ে এনেছি।