দুই সপ্তাহে রডের দাম বেড়েছে টনে ৪ হাজার টাকা
মো. আখতারুজ্জামান : [১] দেশের বাজারে মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এমএস মাইল্ড স্টিল রডের দাম টনপ্রতি প্রায় চার হাজার টাকা বেড়েছে। উৎপাদনকারীরা এর জন্য গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের বুকিং দরের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি এবং ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন। খবর- টিবিএস
[২] ইস্পাত কারখানাগুলোর তথ্যমতে, বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মধ্যে ৭৫ গ্রেডের প্রতিটন এমএস রড বিক্রি হচ্ছে ৯৩,০৯৫ হাজার টাকা দামে। যা নির্বাচনের আগে ছিল টনপ্রতি ৯০ থেকে ৯১ হাজার টাকা।
[৩] ৭৫ গ্রেডের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রডের মধ্যে বর্তমানে প্রতিটন বিএসআরএম ৯৫ হাজার টাকা, জিপিএস সাড়ে ৯৩ হাজার টাকা, কেএসআরএম ও একেএস ৯৩ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। নির্বাচনের আগে বাজারে প্রতিটন বিএসআরএম সাড়ে ৯১ হাজার টাকা, জিপিএস সাড়ে ৯০ হাজার টাকা এবং কেএসআরএম ও একেএস ৯০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হতো।
[৪] ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এখনো অনেক সরকারি প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শুরু হয়নি। এছাড়া বেসরকারি বড় আবাসন-বাণিজ্যিক প্রকল্পের কাজও অনেকটা স্থবির। তারা বলছেন, রডের চাহিদা ও বিক্রি দুটোই বর্তমানে কম।
[৫] দেশের শীর্ষ রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেন গুপ্ত বলেন, ইস্পাত খাত এখন সংকটপূর্ণ সময় পার করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের বুকিং দর বৃদ্ধি, ডলার সংকটের কারণে পর্যাপ্ত আমদানি না হওয়ার কারণে ইস্পাতের কাঁচামালের দাম টনপ্রতি ৮১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। [৬] তিনি আরও বলেন, চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে কারখানার উৎপাদন অব্যাহত রাখতে গিয়ে তিনগুণ বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে।
[৭] নির্মাণ মৌসুম শুরু হলেও এ বছর রডের চাহিদা ও বিক্রির পরিমাণ খুবই কম। ফলে রডের দাম কিছুটা বাড়লেও এই দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি নয়, বলেন তিনি। [৮] এইচএম স্টিল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম বলেন, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে এই শিল্পে সংকট লেগে আছে। ডলার সংকটের কারণে এখন চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। ফলে ইস্পাতের কাঁচামাল আমদানি চাহিদার তুলনায় কমে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে।
[৯] সহসা এই সমস্যা না কাটলে কয়েক মাস পর কাঁচামালের তীব্র সংকট হতে পারে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী। চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জ এলাকার রড ব্যবসায়ী ও মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজ’র স্বত্বাধিকারী এসএম কামরুজ্জামান বলেন, প্রায় দুই মাস নিম্নমুখী থাকার পরে নির্বাচনপরবর্তী সময়ে আবারও বাড়তে শুরু করেছে রডের বাজারদর। [১০] বিশ্ববাজারে স্ক্র্যাপের দাম ও ডলারের বিনিময়মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে স্বাভাবিকভাবেই রডের দাম কিছুটা বাড়বে। কিন্তু বাজার তার চেয়ে বেশি অস্থির হয়েছে রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কথিত সিন্ডিকেট করে কারসাজির কারণে, বলেন তিনি।
[১১] তিনি বলেন, এক সময় শুধু চট্টগ্রামেই ছোট-বড় দেড়শ রড উৎপাদনকারী কারখানা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন সংকটের কারণে গত কয়েক বছরে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
[১২] বর্তমানে অটো মিলের ৬০ গ্রেডের মধ্যে প্রতিটন গোল্ডেন ইস্পাত ও এইচএম স্টিল-এর এমএস রড ৯০ হাজার টাকা, বায়েজিদ স্টিল ৮৯ হাজার ৫০০ টাকা, কেআর স্টিল ও এসএস টাইগার ৮৮ হাজার ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। [১৩] গত দুই সপ্তাহে সেমি অটো মিলের ৬০ গ্রেডের রডের দামও চার হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমানে প্রতিটন গোল্ডেন ইস্পাত ৬০ গ্রেড রড ৮৬ হাজার টাকা, জিরি সুবেদার ও আল ছাফা ৮৫ হাজার টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। ইস্পাতের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার চিত্র মিলেছে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যেও।
[১৪] গত বছরের ডিসেম্বরে দেশে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে মাত্র ১৭ হাজার ৯৬৯ টন। এর আগে নভেম্বরে ৫৪ হাজার ১৩৮ টন, অক্টোবরে ৪৮ হাজার ৩৫৬ টন, সেপ্টেম্বরে ২১ হাজার ১০৭ টন এবং আগস্টে এক লাখ ৮১ হাজার ৯৯২ টন স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করা হয়েছিল।
[১৫] এদিকে আমদানি কমে যাওয়ায় সরবরাহ সংকটে ইস্পাত তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল স্ক্র্যাপ, প্লেট ও বিলেটের দামও অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। গত এক সপ্তাহে এসব কাঁচামালের দাম টনে ৮১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
[১৬] শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোর তথ্যমতে, বর্তমানে ইয়ার্ডে প্রতিটন স্ক্র্যাপ ৬৩ হাজার টাকা, প্লেট ৭৫ হাজার টাকা এবং বিলেট ৭৭ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অক্টোবরের শেষ নাগাদ স্ক্র্যাপ ৫৫ হাজার টাকা, প্লেট ৬৫ হাজার টাকা এবং বিলেট ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
[১৭] ইস্পাত ও শিপ ব্রেকিং খাতের ব্যবসায়ী কেআর গ্রুপের চেয়ারম্যান সেকান্দার হোসেন টিংকু বলেন, গত তিন মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপ জাহাজের দাম টনে ২৫ ডলার পর্যন্ত বেড়ে গেছে। বর্তমানে প্রতিটন স্ক্র্যাপ জাহাজের বুকিং দর ৫২৫ ডলার, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ৪৯০-৫০০ ডলার।
[১৮] বুকিং দর বৃদ্ধি, ঋণপত্র খোলার চ্যালেঞ্জের কারণে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি কমে এখন বেশিভাগ ইয়ার্ড বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে মাত্র ১ হাজার ০১২টি ইয়ার্ডে কার্য়ক্রম চলছে বলে জানান তিনি।