
আমাদের পরিবেশগত নীতির জড়তা
ড. হাসিব মো. ইরফানউল্লাহ : বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (বিসিসিএসএপি) ২০১৮ সালে শুরু হয়েছিলো বিসিসিএসএপির ১০ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার ঠিক আগে। যদিও ২০১০-২০১৮ সময়কালে বিসিসিএসএপি বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটিএফ) থেকে ৩,১৯৮ কোটি টাকা ব্যয় করে ৬২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নের সূচনা করেছিল। কিছু কারণে জার্মান সরকার বিসিসিএসএপি সংশোধনকে সমর্থন করেছিলো। বিভিন্ন ফোরামে আমরা এলোমেলোভাবে এই সংশোধনের অগ্রগতি সম্পর্কে শিখেছি, কিন্তু দৃশ্যত সরকারের কাছ থেকে সম্প্রতি কোনো আনুষ্ঠানিক আপডেট পাইনি, দুটি ঘটনা ছাড়া : [১] তার অর্থবছর ২০২৩-২৪-এর বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বিসিসিএসএপির আপডেটের কথা স্বীকার করেছেন; [২] সাম্প্রতিক জলবায়ু বাজেট রিপোর্টে (২০২৩-২৪), সংশোধিত বিসিসিএসএপি কাঠামোর খসড়াটি কার্যনির্বাহী সারাংশে সংক্ষিপ্তভাবে স্পর্শ করা হয়েছে, তবে মূল পাঠ্যটিতে কোনও বিশদ বিবরণ ছাড়াই।
বিসিসিএসএপি সংশোধনের ধীর গতি সত্ত্বেও গত পাঁচ বছরে সরকার ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ (বিডিপি২১০০), ২০২১ সালে আপডেট করা জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি), বাংলাদেশের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (২০২৩-২০৫০) অনুমোদন করেছে। (এনএপি২০৫০) ২০২২ সালে ও মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা ২০২২-২০৪১ (এমসিপিপি২০৪১) ২০২২-এ সবই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। আমি বিশ্বাস করি সরকারের বিসিসিএসএপি সংশোধন করার জন্য আর বেশি সময় বিনিয়োগ করা উচিত নয়, যা পরিবর্তিত জলবায়ুতে পরিবর্তিত জলবায়ু, রাজনৈতিক ও অর্থায়নের পরিস্থিতিতে দৃশ্যত অপ্রচলিত হয়ে পড়ে। (২০০৯ সালে সংশোধিত ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অফ অ্যাকশন (এনএপিএ) তৎকালীন একেবারে নতুন বিসিসিএসএপির কারণে একইভাবে অপ্রচলিত হয়ে পড়ে)। নতুন সরকারের উচিত দুটি কাজের উপর ফোকাস করা: প্রথমত বিডিপি২১০০, এনএপি২০৫০ ও এমসিপিপি২০৪১-এর মধ্যে সমন্বয় শনাক্ত করা এবং একটি আপডেটেড বিসিসিএসএপির অনুপস্থিতিতে সম্পদ বরাদ্দ করার জন্য বিসিসিএসএপির জন্য একটি নির্দেশিকা প্রস্তুত করা। দ্বিতীয়ত সরকারের উচিত এনএপি২০৫০ হস্তক্ষেপগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া ও বাস্তবায়ন শুরু করা, যা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অমীমাংসিত। এটি সরকারি সংস্থা ও উন্নয়ন অংশীদারদের উপলব্ধ ও প্রত্যাশিত সংস্থানগুলোকে চ্যানেলের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ফোকাস দিতে পারে।
উপরে বর্ণিত পরিবেশগত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ধীর গতি বাংলাদেশে বেশ সাধারণ। ১৯৮০-এর দশকে প্রথম ধারণা করা হয়, জাতীয় সংরক্ষণ কৌশল (এনসিএস) দীর্ঘতম অনুমোদনের সময়ের রেকর্ড রাখে। ১৯৯৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, খসড়া এনসিএস মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেতে পারেনি। ২০১৫-২০১৬ সালে শেষ প্রচেষ্টায়, বিসিসিটিএফ এর অর্থ দিয়ে, বিএফডি ও আইইউসিএন ২৫ জন বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞের সহায়তায় এনসিএস আপডেট করেছে। সাত বছর পর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় (এমওইএফসিসি) চূড়ান্ত বাংলাদেশ জাতীয় সংরক্ষণ কৌশল (২০২১-২০৩৬) প্রকাশ করেছে। বিপরীত প্রবণতায়, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন, ২০১০-এর দ্রুততম আইন প্রণয়নগুলোর মধ্যে একটি। এটি অক্টোবর ২০১০-এ অনুমোদিত হয়েছিলো, সরকার বিসিসিএসএপি(২০০৯)-এর অনুমোদনের মাত্র ১৩ মাস পরে-যার বাস্তবায়ন এই আইনের ভিত্তি। একইভাবে সংবিধানের ১৫ তম সংশোধনীর পরপরই, যা ১৮এ অনুচ্ছেদ যুক্ত করেছে ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে রাষ্ট্রের দায়িত্বে পরিণত করেছে, আমরা হালনাগাদ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ দেখেছি। পাঁচ বছর পরে নতুন সুরক্ষিত এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধি, ২০১৭ এই আইনের অধীনে প্রণীত হয়েছিলো, যা বাংলাদেশের জন-কেন্দ্রিক প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার ২০ বছরের অভিজ্ঞতাকে একটি আইনি ভিত্তি দিয়েছে। একই শিরায় আমরা ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া ম্যানেজমেন্ট রুলস, ২০১৬ (বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর অধীনে) ও দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭ প্রণয়নও দেখেছি।
যদিও এই আইনগুলোর মধ্যে অনেকগুলো বন বিভাগকে তার দায়িত্ব পালনে সহায়তা করে, ২০১৬ সালে খসড়া করা জাতীয় বন নীতি এখনও মন্ত্রিসভা দ্বারা অনুমোদিত হয়নি। একই বছরে খসড়া প্রণীত বাংলাদেশ বনায়ন মহাপরিকল্পনা (২০১৭-২০৩৬) অনুমোদনে একই বিলম্বের সম্মুখীন হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক-সমর্থিত স্ট্রেন্থেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন (এসআরসিডব্লিউপি) প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ মহাপরিকল্পনা (২০১৫-২০৩৫) আন্তর্জাতিক পরামর্শক সংস্থাগুলো ২০১৫ সালে তৈরি করেছিলো। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২০-২০২৫) অনুযায়ী , দেশের সংরক্ষণ প্রচেষ্টা এই মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী হওয়া উচিত। কিন্তু জৈব বৈচিত্র্য সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নথিতে এই পরিকল্পনার কোনো উল্লেখ নেই, যেমন পঞ্চম (২০১৫) ও ষষ্ঠ (২০১৯) জৈব বৈচিত্র্য সংক্রান্ত কনভেনশন (সিবিডি) বা জাতীয় জীববৈচিত্র্য কৌশল ও কর্ম পরিকল্পনা (এনবিএসএপি) এর জাতীয় প্রতিবেদনে (২০১৬-২০২১) ।
এনবিএসএপি-এর কথা বলতে গেলে, এই নীতি উপকরণটি গত ২০ বছরে তৈরি করা অন্যান্য বেশ কয়েকটি পরিবেশগত পরিকল্পনায় যোগ দেয়, যেগুলো খারাপভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ সরকার নির্ধারিত কৌশলগত সময়ের মধ্যে তাদের বাস্তবায়নের জন্য খুব কমই পদক্ষেপ নেয়। এই ধরনের অন্যান্য পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে এনএপিএ (২০০৯), বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ও জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যান (সিসিজিএপি, ২০১৩) বাংলাদেশ কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান ফর এনভায়রনমেন্ট, ফরেস্ট্রি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ (২০১৬-২০২১)। বাংলাদেশ ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্টাল গভর্নেন্স (সিডিএপি ২০০৭) অপ্রচলিত হওয়ার আরেকটি প্রধান উদাহরণ। এই পরিকল্পনাটি তিনটি রিও কনভেনশনকে একত্রিত করার কথা ছিলে, যথা সিবিডি, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (ইউএনএফসিসিসি) জাতিসংঘের কনভেনশন টু কমব্যাট মরুকরণ (ইউএনসিসিডি)। পরিশেষে নীতির আরেকটি গ্রুপের মধ্যে রয়েছে যেগুলো প্রাথমিক ধারণার পরেও চালু হয়নি। উদাহরণস্বরূপ প্রথম এনবিএসএপি (২০০৪), জাতীয় জীববৈচিত্র্য নীতি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছিলো। আমাদের নতুন সরকার শীঘ্রই ২০৩০/২০৫০-এর জন্য জিবিএফ-এর অধীনে কুনমিং-মন্ট্রিল গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্ক (সিবিডি)ও এনডিসি (২০২১) আপডেট করার জন্য একটি নতুন এনবিএসএপি প্রস্তুত করা শুরু করবে। আমাদের কি এমন একটি দেশ হওয়া অব্যাহত রাখা উচিত যেটি সুন্দর পরিবেশ নীতির উপকরণ তৈরি করে ও তারপরে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে ভুলে যায়?
ড. হাসিব মো.ইরফানউল্লাহÑ পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও গবেষণা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা একজন স্বাধীন পরামর্শক। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো। সূত্র : ডেইলি স্টার। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ
