সবার জন্য নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন কবে পূরণ হবে?
মো. জিল্লুর রহমান : সড়কে ভয়ংকর মৃত্যু থামছে না। দুর্ঘটনা রোধে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা আমরা শুনি, কিন্তু তাতে দুর্ঘটনা কমেনি। বেপরোয়া যান চলাচল বন্ধ হয়নি। এর অর্থ হলো দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা তাদের বাস্তবায়নে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ফাঁক রয়েছে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি হওয়ায় এগুলো দূর করা খুবই জরুরি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ৮০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত গতি ও চালকের অসতর্কতার কারণে। একটানা চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর একজন চালকের বিশ্রাম নেওয়া উচিত, এটাই নিয়ম কিন্তু দেশের কোনো চালকই এই নিয়ম মানে না। ফলে ক্লান্ত চালক গাড়ি চালালে স্বাভাবিকভাবেই দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেশি থাকে। এটি মূলত বাস মালিকদের অতিরিক্ত বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে। এ প্রবণতা রোধে সরকারের কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। সরকারের সড়ক পরিবহন সেক্টরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এর সাম্প্রতিক একটি তথ্য বলছে যে গত বছর ২০২৩ সালে প্রতিদিন প্রায় ১৪ জন সড়কে মারা গিয়েছিলো। ২০২৩ সালে সারা দেশে ৫,৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, এসব দুর্ঘটনায় ৫,০২৪ জন মারা গেছে ও ৭,৪৯৫ জন আহত হয়েছে। তবে সড়ক দুর্ঘটনার সরকারি তথ্য ও বেসরকারি সংস্থার তথ্যের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত সাড়ে ছয় হাজার মানুষ মারা যায়।
বাংলাদেশ পুলিশের মতে এই সংখ্যাটি ৪,৪৭৫, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের মতে এটি ৬,৫২৪ ও বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭,৯০২ জন মারা গেছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের মতে, ২০২২ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭,৭১৩ জন মারা গেছে। আগের বছর ২০২১ সালে নিহতের সংখ্যা ছিলো ৬,২৮৪ ও ২০২০ সালে ৫,৪৩১ জন। মজার ব্যাপার হলো, সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ প্রথমবারের মতো সড়ক দুর্ঘটনার বার্ষিক তথ্য প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি সারাদেশে ৬৪টি সার্কেল অফিসের মাধ্যমে পুলিশ বিভাগ, জেলা প্রশাসন জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য যাচাই ও প্রকাশ করে। তবে বিআরটিএর দেওয়া সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যার সঙ্গে একমত নন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন সরকারি সংস্থার দেওয়া হিসাবও ভয়াবহ। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ, ধর্মঘট ও অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে দূরপাল্লার যানবাহন কম চলছে। তারপরও সড়কে দুর্ঘটনায় এতো মানুষ মারা গেছে, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সড়ক দুর্ঘটনা একটি জাতীয় সমস্যা। দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয়। শুধু কথা বা আশ্বাস সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে না, মৃত্যুও কমবে না।
প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা খুবই বিশৃঙ্খল ও দুর্ঘটনাপ্রবণ, যা রাজধানী ঢাকার বাস সার্ভিসে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। ২৯ জুলাই ২০১৮ শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ২৮,২৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯,৫২২ জন নিহত ও ৫৮,৭৯১ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩,৯৪১ জন শিক্ষার্থী ছিলো। তবে নিরাপদ সড়কের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, সড়ক নির্মাণে ত্রুটি, মানহীন যানবাহনের অবাধ চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, চালকের বেপরোয়া মনোভাব, মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার, চালকদের মাদকের ব্যবহার, লেভেল ক্রসিং ও হাইওয়েতে ফিডার রোড থেকে হঠাৎ করে যানবাহন বের হয়ে যাওয়া, ফুটপাতের অভাব বা ফুটপাথ ফাঁকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা গবেষণা অনুযায়ী এসব সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩ শতাংশ ঘটে অতিরিক্ত গতির কারণে; ৩৭ শতাংশ চালকদের অসতর্ক মনোভাবের কারণে বাকি ১০ শতাংশ যানবাহনের ত্রুটি ও পরিবেশের কারণে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়ক নিরাপত্তা ও নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করে। সংস্থাটি বেপরোয়া গাড়ি চালানো সহ সড়ক দুর্ঘটনার ৯(নয়)টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- যানবাহনের বেপরোয়া গতি, অযোগ্য যানবাহনে যাত্রী বহন, পণ্যবাহী যান বন্ধের সিদ্ধান্ত অমান্য করা, অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়ে যানবাহন চালানো। সংস্থাটি দুর্ঘটনা কমাতে ১২ (বার)টি সুপারিশ করেছে। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া ও নৈরাজ্য বন্ধ, চালক প্রশিক্ষণ, ঈদ যাত্রায় মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা, ঈদ-পরবর্তী মনিটরিং কার্যক্রম বহাল রাখা, চালক-শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করা, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদকে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। দুর্ঘটনা রোধে সময়োপযোগী সড়ক পরিবহন আইন জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি। আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু পরিতাপের বিষয় তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের কঠোর শাস্তির নজির নেই। সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কমিটি ১১১টি সুপারিশ করেছিলো, যা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও ২০১৮ সালের জুন মাসে ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। নির্দেশনাগুলো হলো দূরপাল্লার যানবাহনে বিকল্প চালক রাখা, একজন চালক যেন পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে না পারে, চালক ও তাদের সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সার্ভিস সেন্টার বা নির্দিষ্ট দূরত্বে রাস্তার পাশে বিশ্রামাগার, সিগন্যাল অনুযায়ী অনিয়মিত রাস্তা ক্রসিং বা পথচারী ক্রসিং বন্ধ করা, জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার, চালক ও যাত্রীদের সিট বেল্ট পরা নিশ্চিত করা। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী তিন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রীর যৌক্তিক নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। মনে হয় বইতে গরু পাওয়া গেলেও বাস্তবে তা নেই!
সড়ক নিরাপত্তা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা হলেও বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের কাছে তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না, যার কারণে কমছে না দুর্ঘটনা। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর ছয় দফা নির্দেশনা, সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এ সংক্রান্ত কমিটির ১১১টি সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন। সড়ক পরিবহন আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়কে প্রতিদিনই কোনো না কোনো প্রাণ নেওয়া হবে, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে এবং সময়ে সময়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন-সংগ্রাম চলতেই থাকবে। তবে এর স্থায়ী অবসান হওয়া দরকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো সবার জন্য নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের স্বপ্ন কবে নিশ্চিত হবে নাকি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের বিপরীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সারি বাড়তেই থাকবে। লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ