নেদারল্যান্ডের বীজ থেকে আলু চাষ হলে, সেটা যদি ম্যাকডোনাল্ডের মানের হয়, তাহলে আমাদের একটা রপ্তানির দরজা খুলতে পারে
কাজী এম মুর্শেদ
আজকের বিষয় আলু। খাবার আলু, সেই আলুর দোষের আলু নয়। সেই সত্তর বা আশির দশকে একটা শ্লোগান ছিলো, ‘ভাতের বদলে আলু খান, ভাতের উপর চাপ কমান’। বাঙালি অভ্যাসের দাস। ভাত, পেঁয়াজ, মরিচ, লবন ছাড়া চলে না। আলুর উপর নির্ভর করলে সম্ভবত খারাপ হতো না। যারা মনে করছেন এটা হাসির কথা, পরিষ্কার করে দিই, ভাত এবং আলু দুইটাই শ্বেতসার, একটার সাবস্টিটিউট অন্যটা হতে পারে। আরও পরিষ্কার করি, বিদেশে খাবার আইটেমগুলোর মধ্যে একটা পছন্দের জিনিস স্টেক। মাংসের বড় একটা টুকরো থাকে, কিছু ভেজিটেবেল, সঙ্গে অপশন দুইটা, হয় স্টিম রাইস বা ম্যাশ পটেটো। এটা যে সাবস্টিটিউট সেটা বোঝানোর জন্য বললাম। লেখার ইচ্ছা ছিলো না, নিউজ দেখে লিখছি, সঙ্গে পুরনো একটা গল্প বলবো।
টিভিতে দেখাচ্ছে নেদারল্যান্ড এম্বেসির সহায়তায় তাদের বীজ থেকে আলু চাষের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বাজারে আলুর দাম বেড়েছে বলে স্থানীয় দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য ৩৪ হাজার মেট্রিক টন আলু ভারত থেকে আনার অনুমতি দিয়েছে। বাংলাদেশের আলুর মান ভালো, বিশেষ করে বগুড়ার লাল আলু খুবই ভালো স্বাদের ও মানের। আমাদের এবারই আলু নিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছে, বিশেষ করে মাঝে কয়দিন ঠাণ্ডা পরায়, সূর্য না থাকায় এবং অতিরিক্ত কুয়াশায় উত্তরবঙ্গের বেশকিছু এলাকায় আলু চাষীরা নতুন আলু চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এটা সত্য।
আলুর দাম বাড়ানো কতোটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্নে গেলাম না, কারণ দেশে যে সব কোল্ড স্টোরেজ আছে, সেখানে আলু অনেকটা জায়গা করে নেয়। আলু পঁচনশীল নয়, ফলন ভালো না হলেও আগের রাখা আলুর জন্য সমস্যা হবার কথা ছিলো না, কিন্তু মধ্যসত্বভোগীরা বলবেন বিশ্ব পরিস্থিতি ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আলুর দাম বেড়ে গেছে। সত্য কথা বলতে সাহস পান না, ট্রাক প্রতি যতো টাকা দিয়ে আলু পৌঁছায়, কারা এই অতিরিক্ত টাকা নেয়, সেটা বললে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা মূলত তিন রকমের আলুতে অভ্যস্ত। শিক্ষার অংশ হিসাবে আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বীট, শালগম, মরিচ, পেঁয়াজ, মিষ্টি আলু এমন অনেক কিছুর চাষ করেছি, সামান্য কিছু এখনো মনে আছে। সবচেয়ে বেশি আসে একটু বড় সাইজের আলু। ভারতের আলুর সঙ্গে তেমন পার্থক্য বুঝবেন না। দ্বিতীয় ধরন ছোট সাদা নতুন আলু, আর তৃতীয় বগুড়ার লাল ছোট আলু। পরের দুইটার স্বাদ বেশ ভালো। আমাদের এ ধরন দুটোই বেশি দামে চলে। বড় আলুগুলো মূলত কোল্ড স্টোরেজ থেকে আসা।
সরকার যে আলু আমদানির অনুমতি দিয়েছে, আমার ধারণা কোল্ড স্টোরেজগুলোর সঙ্গে এতোটাই মিল, আপনি আলাদা করতে পারবেন না। তবে একটু হলেও ভালো ও খারাপ খবর আছে। ভালো খবর হলো, সরকার ১৬ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেবার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে দাম কমে গিয়েছিলো। মোট ডিম ভারত থেকে এসেছে ৬২ হাজার, যা অনুমতি দেবার তার তুলনায় কিছুই না। ভালো খবর, এই আলু আমদানির অনুমতি দেবার পর যদি কোল্ড স্টোরেজের দরজা খোলে, ভারত থেকে আলু আসার দরকার পরবে না। খারাপ খবর হলো, ভারত থেকে কাঁচামরিচ আসছিলো ২৬ টাকা কেজি করে। এটা ৩৬ টাকায় বিক্রির কথা ছিলো, কিন্তু ব্যবসায়ীরা দেশি মরিচের সমান ১৭৫ টাকায় বিক্রি করেছিলো। নেদারল্যান্ডের বীজের আলুর ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়, তবে ধারণা করতে পারি, সাধারণ মানুষ কিনবে না, অন্যদিকে এর বড় লাভজনক দিক আছে। সেই কথাটা বলতে একটা গল্প বলি। আমি ভারতে কয়েকবার গেছি, তবে প্রতিবারই সেটা ব্যাঙ্গালোর ছিলো। আমি ওই এলাকার মানুষদের অসম্ভব রকম পছন্দ করি। তারা সৎ, সত্যবাদী, খোলামনের এবং পরোপকারী। ওই এলাকায় আপনার ইংরেজিতে কথা বলতে হবে, তারা হিন্দি সহজে নেয় না।
মূল গল্পে আসি। সালটা সম্ভবত ১৯৯৫ বা ১৯৯৬ হবে, ব্যাঙ্গালোর এ ম্যাকডোনাল্ডস খুলেছে। ধর্মীয় কারণে বীফ ছিলো না, সেখানে ভেজিটেবল বার্গার চলতো। আপনারা যদি কিছু দেশ ঘোরেন এবং ম্যাকডোনাল্ডে যান, একটা ব্যাপার খেয়াল করতে পারেন, এদের ফ্রেঞ্চ ফ্রাই একদম একরকম। নির্দিষ্ট সাইজের হবে, স্বাদ একরকমের হবে। ভারতের এই ম্যাকডোনাল্ডের জন্য যে আলু ব্যবহার করা হয়, সেটা ভারতে হয় না বলে আমদানি করতে হয়। সেসময় কর্নাটকের আলুচাষীরা বিদ্রোহ করে, তাদের কথা দেশিয় আলু ব্যবহার করতে হবে। ম্যাকডেনাল্ড তাদের কোয়ালিটির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করবে না, তাতে দাম বাড়লে বাড়বে, অন্যদিকে আলুচাষীরাও ছাড় দেবে না। অবশেষে কর্নাটক সরকারের মধ্যস্থতায় সভা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ভারতের আলু তারা নেবে না, তবে যেসব সোর্স থেকে আলু আনা হয়, তার বীজ এনে দেবে। রেজিস্টার্ড কৃষকরা এই বীজ দিয়ে আলু চাষ করবে, পুরো যা উৎপাদন হবে সেটা ম্যাকডোনাল্ডকেই বেঁচতে হবে, বাইরে বেঁচতে পারবে না। সেটা বেশি দাম হলেও তারা নেবে, এমনকি নির্দিষ্ট মাপের না হলেও সেটা বাইরে যাবে না, কিছু কম দামে কিনে নেবে এবং নষ্ট করে ফেলবে। আলুচাষীরা এতে একমত হয়, সঙ্গে ম্যাকডোনাল্ড এবং সরকারও। গল্পটা বলার কারণ, নেদারল্যান্ডের এই আলুগুলো যা চাষ হবে সেটা যদি ম্যাকডোনাল্ডের মানের হয়, আমাদের একটা রপ্তানির দরজা খুলতে পারে। মান নিয়ন্ত্রণ করা দরকার হবে, ইমানদারীর সঙ্গে যেই চুক্তিতে বিক্রয় করার কথা যদি ওঠে তা মানতে হবে। এখনো আশা করছি, ভারত থেকে আলু আমদানি করা লাগবে না। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর যদি কোল্ড স্টোরেজগুলোতে সাহস করে অভিযান চালায়, হয়তো এক মেট্রিক টন আলুও আনতে হবে না। লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক