রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করুন
সৈয়দা নশীন শর্মিলী : মহামারীটি পৃথিবীর বুকে আঘাত হানার পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাপক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে। ক্ষতটিতে লবণ যোগ করার জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একটি ক্ষতিকারক হিসেবে আঘাত করেছিলো ঠিক যখন দেশটি ধীরে ধীরে কোভিড-১৯ থেকে তার সমাধান ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছিলো। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের সঙ্কট গত বছর থেকে সারা বছর ধরে এই ক্রমবর্ধমান ইস্যুগুলোর কারণে অর্থনীতিতে ছিটকে পড়েছে। দেশটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছর থেকে যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয়েছে ও কীভাবে এটি ২০২৪ সালে প্রবেশ করতে পারে তার একটি তালিকা এখানে রয়েছে। রমজান মাস তিন মাসেরও কম সময় বাকি আছে, প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনও ক্রয়ক্ষমতার আওতায় আনা হয়নি। গত বছর দেশে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে অক্টোবরে ১২.৫৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা প্রায় ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের প্রয়োজনীয় মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বাসস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সামগ্রিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিলো ৯.৫৮ শতাংশ। ডিসেম্বর ২০২৩- একটি ধীর তবে অনেক প্রয়োজনীয় পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দেয়। সাম্প্রতিক উন্নয়নে সরকার একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করেছে যেখানে গ্রাহকরা দৈনিক পণ্যের জন্য অতিরিক্ত চার্জ করলে ৩৩৩ ডায়াল করতে পারেন।
রমজান মাসের আগে, সরকার ব্যবসায়ীদের জন্য ক্রেডিট এলসি খোলার বিকল্প খোলার পরিকল্পনা করছে যাতে পণ্যের ঘাটতি না হয়। সরকারের উচ্চ মহল দীর্ঘদিন ধরে দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী ‘অদৃশ্য সিন্ডিকেট’ সম্পর্কে কথা বলে আসছে। এর আলোকে বাজার নিয়ন্ত্রণে এ ধরনের সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে ডলার সংকটের ঘরে হাতি। মহামারী চলাকালীন দেশটি তার ইতিহাসে সর্বোচ্চ ফরেক্স রিজার্ভ দেখেছে ৪৮ বিলিয়ন ডলার। আমদানি চাহিদা না থাকায় ও বৈধ মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের শুরুতে সঙ্কট তৈরি হয়েছিলো, যেখানে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইন আলোচনা ব্যাহত হয়েছিলো। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ডলারের সংকট মোকাবেলা করা জটিল ও এখনও প্রতিরোধ করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের সংকট কমাতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে যেখানে আউটপুট মিশ্র ফলাফলের সঙ্গে ফিরে এসেছে। সামষ্টিক অর্থনীতির সুবিধার্থে আইএমএফ-এর সঙ্গে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিবি বিদেশি মুদ্রার বাজার অস্থির হয়ে যাওয়ার পর জুলাই ২০২২ থেকে ডলার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। এটি অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনকে (বিএফইডিএ) ডলারের রেট নির্ধারণ ও এটিকে বাজারমুখী করার নির্দেশ দিয়েছে। তবে ডলারের দর এখনও নিয়ন্ত্রণে নেই।
অন্যদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে কারণ সরকার এখন রেমিট্যান্স প্রবাহে ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা প্রদান করছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি তাই আশীর্বাদ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে কারণ নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ১.৯৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে, যা বছরে ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রোববার আপডেট করা বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ গত বছরের একই মাসের তুলনায় অতিরিক্ত ৩৩৪.৮ মিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পেয়েছে। অভিবাসীরাও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুলাই-নভেম্বর সময়ের মধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আরও বেশি অর্থ প্রেরণ করেছে। তারা পাঁচ মাসে ৮.৮১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছে। যদিও রেমিট্যান্স প্রবাহ ঊর্ধ্বগতিকে বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, তবুও ডলার সংকট ২০২৪ সালে জ্বলন্ত সমস্যা হিসেবেই থাকবে। দেশের উন্নয়নে আর্থিক খাত উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বিস্তৃতভাবে তিনটি খাত অবদান রেখেছে যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তিকে শক্ত করেছে-ব্যাংকিং খাত, এফডিআই ও অবকাঠামো। ৮০ এর দশকের শেষের দিকে ব্যাংকের বেসরকারিকরণের যাত্রা শুরু হয় যা ব্যাংকিং খাতকে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণ খেলাপি কেলেঙ্কারির পরে এই খাতের দুর্বলতাগুলো উন্মোচিত করেছে। ব্যাংকিং খাতকে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করা হচ্ছে। সরকার পরবর্তীদের দ্বারা প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত করতে আইএমএফের সঙ্গে সহযোগিতা করছে।
আমরা ২০২৪ এ প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের চ্যালেঞ্জ হলো আর্থিক খাতকে পঙ্গু করে দেওয়া এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা। বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে স্বয়ংক্রিয়করণ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক উন্নয়ন করেছে এই খাতের সুষ্ঠু পরিচালনা নিশ্চিত করতে। গত চার বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। দেশটি বেশ কিছু বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষেত্রে সফলতা প্রদর্শন করেছে। নিক্কিস কোভিড-১৯ পুনরুদ্ধার সূচকে ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৫তম ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ১ম স্থানে রয়েছে, যা মহামারী চলাকালীন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপদের সময়ে যথেষ্ট স্থিরতা প্রদর্শন করে। মাস্টারকার্ড ইকোনমিক্স ইনস্টিটিউট (এমইআই) এর বার্ষিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আগামী বছর ৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি হবে ২০২৪ সালে প্রত্যাশিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশ যেখানে ভারতের প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি ৬.৪ শতাংশ, সর্বোচ্চ তালিকার দেশগুলোর মধ্যে। লন্ডন ভিত্তিক সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) এর আরেকটি পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। বৃদ্ধির ধারার ঊর্ধ্বগতি নিশ্চিত করুন।
লেখক : বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর করছেন। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ