মাটি পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের কৌশল
ড. মো. নুরুল হুদা আল মামুন : মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি সব উদ্ভিদেরও খাদ্য প্রয়োজন। আমরা জানি যেকোনো ফসলের জীবনচক্রে (বীজ থেকে বীজ) উদ্ভিদের যে পুষ্টির প্রয়োজন তার মধ্যে ১৭টি পুষ্টি উপাদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ১৭টি পুষ্টি উপাদানের বাইরে আরও অনেক পুষ্টি উপাদান রয়েছে, কিন্তু সেগুলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। ক্রমাগত ফসল চাষের ফলে মাটি থেকে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান ধীরে ধীরে একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে যায়। বাংলাদেশের মোট কৃষি জমির ৭৫ শতাংশ উর্বরতা হারিয়েছে। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তনের পর থেকে মাটিতে মৌলিক উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একজন কৃষক বহু বছর ধরে একের পর এক ফসল চাষ করছেন, ফলে জমি বিশ্রাম পায় না। প্রতিটি চাষের সময় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। জৈব সারও কখনও কখনও দেওয়া হয়, যদিও প্রয়োজনের তুলনায় কম মাত্রায়। অধিকাংশ কৃষকই কম জৈব সার ব্যবহার করেন, ফলে মাটির চরিত্র পরিবর্তন হয়। বেশি লাভের জন্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছেন কৃষকরা। সুষম ও পরিমিত পরিমাণ সার ব্যবহার না করা। ফলে দিনের পর দিন এভাবে চলার ফলে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে, ফলনও কম হচ্ছে।
বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় ফসলের জন্য পুষ্টি ব্যবস্থাপনা শীর্ষক প্রকল্পের দলনেতা ও অস্ট্রেলিয়ার মারডক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড ডব্লিউ বেলের গবেষণায় বলা হয়েছে, কৃষক যদি পরিমিত সার ব্যবহার নিশ্চিত করেন, তাহলে ধানের উৎপাদন বাড়বে। প্রতি বছর ৭.৫ মিলিয়ন টনের বেশি। এতে বার্ষিক মোট মুনাফা হবে ২০ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। এ জন্য নিয়মিত কৃষি জমির মাটি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। মাটি পরীক্ষা করে জানা যাবে কী কী পুষ্টি উপাদান কতোটুকু করে পাওয়া যায়। অতিরিক্ত কতো সার বা খাদ্য উপাদান দিতে হবে? আরও দেখা যায়, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম সার জমিতে দেওয়া হচ্ছে বছরের পর বছর। কিন্তু মাটি পরীক্ষার পর দেখা গেলো ফসফেটের মাত্রা অনেক বেশি, পটাসিয়ামের মাত্রা অনেক বেশি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান খুবই কম। কৃষক ফসল অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার ব্যবহার করেছেন, মাটি পরীক্ষার পর দেখা গেছে কিছু সার অপব্যবহার হয়েছে। তাই বছরে অন্তত একবার প্রতিটি প্লটের মাটি পরীক্ষা করা উচিত। যদি সম্ভব না হয়, অন্তত প্রতি ৩-৪ বছর পর পর মাটি পরীক্ষা করা উচিত। এতে শুধু সারের অপব্যবহারই কমবে না, বরং বারবার সার ব্যবহারে মাটিতে সেই সব পুষ্টি উপাদান জমা হবে যা অন্যান্য খাবারকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। মাটিতে বিষাক্ততা তৈরি হয়। রাসায়নিক সারের অত্যধিক ব্যবহার মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুর সংখ্যাও কমিয়ে দেয়, ফলে ফসলের ফলন কমে যায় ও মৃত মাটি যেমন মরুভূমির মাটি বেড়ে যায়। মাটি পরীক্ষা করার পর ও মাটির স্বাস্থ্য জেনে সুষম সার ব্যবহার করলে শুধু আপনার অর্থই সাশ্রয় হবে না, মাটি ও পরিবেশের স্বাস্থ্যও ভালো হবে। এছাড়া মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে কৃষি ফসলের উৎপাদন খরচ ১৫-২৫ শতাংশ কমানো সম্ভব। এসব কারণে মাটি পরীক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
মাটির স্বাস্থ্য সঠিকভাবে জানতে হলে মাটি সংগ্রহের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি জানতে হবে। অন্যথায় সঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে না। এবার জেনে নেওয়া যাক কখন মাটি সংগ্রহ করতে হবে এবং কী কী করা উচিত নয়। জমির ফসল কাটার পর ও পরবর্তী ফসল রোপণের আগে মাটির নমুনা নিতে হবে। অন্য কথায় মাটি নোংরা হলে মাটির নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। প্রথম ০৯টি জায়গা জমিতে প্রায় সমান দূরত্বে নির্বাচন করতে হবে। জমির আইল থেকে কমপক্ষে ২ হাত রেখে স্থান নির্বাচন করতে হবে। জমিতে ফসল থাকলে সেই জমির নমুনা সংগ্রহ না করাই ভালো, তবে জরুরি প্রয়োজনে মাটির নমুনা সংগ্রহ করতে হলে দুই সারির মাঝখান থেকে মাটি সংগ্রহ করা যেতে পারে। যদি জমির অবস্থান ঢালু হয়, তাহলে নমুনা সংগ্রহের স্থানটি নীচের দিকে ২ হাত ও উপরের দিকে ২ হাত রেখে নির্বাচন করতে হবে। জমিতে গাছ থাকলে ছায়াযুক্ত জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা যাবে না। যে জমিতে নতুনভাবে জৈব সার যেমন গোবর, ছাই বা কম্পোস্ট সার বা অজৈব বা রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয়েছে সেখান থেকে মাটি পরীক্ষার জন্য সংগ্রহ করা উচিত নয়। এমনকি জৈব সার স্তূপ করা জমি থেকে মাটির নমুনাও সংগ্রহ করা যায় না। সংগ্রহের পর মাটি রোদে শুকানো উচিত নয়। মাটি পরীক্ষার জন্য মাটির নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সরঞ্জাম হলো: কোদাল, বেলচা, বালতি, পুরানো খবরের কাগজ, পলিথিন শীট, ছুরি, সুতলি ইত্যাদি।
বাংলাদেশে দুই ধরনের মাটি পরীক্ষাগার রয়েছে। প্রথমত, স্থায়ী পরীক্ষাগার ও দ্বিতীয়ত ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করা হয়। যেখান থেকে সার সুপারিশ কার্ড দেওয়া হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে ৭টি বিভাগীয় পরীক্ষাগার, ১৬টি আঞ্চলিক গবেষণাগার রয়েছে। এই বিভাগীয় পরীক্ষাগারগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও ??বরিশালে অবস্থিত। আঞ্চলিক গবেষণাগারগুলো কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, যশোর, নোয়াখালী, রাঙ্গামাটি ও পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত। এই স্থায়ী ল্যাবরেটরির মাধ্যমে প্রায় সব মাটির উপাদান বছরের যে কোনো সময় ৬৩/- টাকায় পরীক্ষা করা যায়। এগুলো ছাড়াও, বর্তমানে ১০টি মোবাইল সয়েল টেস্টিং ল্যাবরেটরি (এমএসটিএল), যেখানে মাটি পরীক্ষা মাত্র ২৫/- টাকায় পাওয়া যায়। পরিশেষে, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অধিক ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য মাটি পরীক্ষাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে সুষম পরিমাণে সার প্রয়োগ করে মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে হবে।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয় আঞ্চলিক পরীক্ষাগার, ফরিদপুর।
সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ