দেশীয় উদ্যোক্তা ও পণ্যে জনগণকে অভ্যস্ত করার এখনই সময়
কাজী এম. মুর্শেদ
বিষয়টা বড় এবং চলমান। আমি কিছু পেছনের কথা বলি। বিষয়টা হলো ইন্ডিয়া আউট। এই উপমহাদেশে ভারত নিশ্চিতভাবেই একটা বড় শক্তি। সেটা অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সুসম্পর্ক যেমন আছে, অনেক দেশের সঙ্গে ততোটা নেই। বিশেষ করে একধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে চীনের সঙ্গে। যদিও আমি মনে করি ভারত এখনো চীনের লেভেলে উঠতে সক্ষম নয়, তারপরও লক্ষ্য উপরে থাকতে হয়। বেশ আগে থেকেই ভারত চীন আউট ক্যাম্পেন চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও চীনকে পাশে সরিয়ে এগোনো সম্ভব নয়, তারপরও আমি সবসময় ভারতের একটা গুণের প্রশংসা করি, তাদের দেশপ্রেমের। এক্ষেত্রে কোনো দ্বিমত রাখে না, অনেকে চীনের পণ্য বর্জন করলেও পুরো করা সম্ভব নয়। ভারতের কাছে চীন আউট একটা গণতান্ত্রিক প্রকল্প। তারা চীনের পণ্য বর্জন করতে চায়, দেশপ্রেমের খাতিরে অনেকটা পারেও। এখানে ব্যাখ্যা করা উচিত, চীন আউট অর্থ চীনের পণ্য বয়কট করা, যেটা একটা সামাজিক আন্দোলন, কোনো সরকারি ঘোষণা নয়। সরকারি ঘোষণা হলে বয়কট হয় না, তখন স্যাংশন হয়। ভারত সরকারের সঙ্গে চীনের বিভিন্ন ফোরামে যোগাযোগ থাকায় স্যাংশন দেওয়া সম্ভব নয়।
মালদ্বীপ দক্ষিণ এশিয়ার সার্কের একটি দেশ। মোট ১১৯২ দ্বীপের এই দেশের ১৮৭ দ্বীপে মানুষ বাস করতে পারে। খাবার-সহ বিভিন্ন ব্যাপারে তারা নিকটবর্তী দুই দেশের উপর নির্ভর করে, ভারত ও শ্রীলঙ্কা। তাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি পর্যটন শিল্প। এবারের ভোটে ভারত ও চীন সমর্থিত দুই দলের লড়াইতে ভারত পরাজিত হয়, জয়ী প্রার্থীর ক্যাম্পেন ছিলো ইন্ডিয়া আউট। তারা চীন ঘেষা বলে পরিচিত। একটা ব্যাপার দেখেন, ভারতের কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গেই তাদের সম্পর্ক ভালো নয়। পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এমনকি মিয়ানমারের সঙ্গেও নয়। শুধু বাংলাদেশ তাদের বলয়ে আছে, তবে সেটা বাংলাদেশ সরকার বা সরকারি দল। সাধারণ জনগণের ব্যাপারে বলবো, বিশ্বকাপে ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজয়ের পর যে উচ্ছ্বাস ছিলো, ভারতের জনগণ মেনে নিতে পারেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা যায় এবং বর্তমান সরকার থাকলে তাদের দরকারি সবই তারা পায়, এটা জনগণের পছন্দ নয়। বাংলাদেশের জনগণ যদিও বলে আমাদের নিজের রাষ্ট্রের অংশ বা অঙ্গরাজ্য মনে করে, এটা ভুল ধারণা। ভারত শুধু নয়, বিভিন্ন দেশ ব্যবসানির্ভর কূটনীতি করে, আমরা এদিকে ব্যর্থ হলেও ভারত সফল। তারা দেশ চায় না, বাজারটা ধরতে চায়। এই বাজার ধরতে বিভিন্ন চাপ তৈরি করে, বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশ বলে নতজানু হয়, সেখানে নেপাল বা ভুটান বা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তান বা মালদ্বীপ কেউই নতজানু হয়নি।
আমাদের দুর্বলতা স্বীকার করলাম, তবে তা জনগণের না। মালদ্বীপের পর্যটনে ভারতের বিশাল অবদান আছে, সবচেয়ে বেশি পর্যটক এই মুসলিম প্রধান দেশেই যায়। কিন্তু গত নির্বাচনের পর ভারত অন্য রাস্তা দেখছে, তাহলো তাদের অধীন লক্ষ্যদ্বীপকে সামনে নিয়ে আসা। এখনো ৫/৬ বছর লাগবে পূর্ণ মর্যাদায় আনতে, এটা ৩৬টা দ্বীপের আরেক টুরিস্ট ডেস্টিনেশন হতে পারে। এটাও ৯৫ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সফরে যান, এটাকে প্রোমোট করাই মূল উদ্দেশ্য ছিলো। পরবর্তী সময়ে যেসব ছবি দেন, তা নিয়ে মালদ্বীপ কিছু মন্তব্য করে যা ভারতের জনগণ মেনে নিতে পারেনি। তিনটা শব্দ ছিলো জোকার, টেররিস্ট ও পাপেট অফ ইসরায়েল। ভারতের কথা আগেই বললাম, তারা বিজেপি কংগ্রেস মারামারি করবে, কিন্তু দেশের উপর আঁচ আসলে সব এক হয়ে যাবে। নরেন্দ্র মোদিকে এই ইনসাল্ট করায় সব দলই বিরোধিতা করেছে, তারা মালদ্বীপকে বয়কট করা শুরু করেছে। অনেকেই প্রায় ৮০০০ প্রথম দিনেই বুকিং ক্যানসেল করেছে। আরেকটু ভাঙ্গায় বলি। জোকার কথার কারণ লক্ষ্যদ্বীপে নরেন্দ্র মোদি লাইফ জ্যাকেট পরা ছবিসহ ডাইভিং করছেন এমন একটা ছবি দেন। দুটো একসঙ্গে চলে না বলেই জোকার শব্দটা এসেছে। টেররিস্ট কথার উৎস সেই ২০০২ এর বুচার অফ গুজরাট থেকে।
আরা ইসরায়েল সৈন্য গাজায় আক্রমণ করলে নরেন্দ্র মোদি ইসরায়েলের সঙ্গে তার সমর্থন দিলে মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে অনেকে পছন্দ করেনি, সেজন্য পাপেট অফ ইসরায়েল বলে। ভারত এটা মানতে পারছে না। এদিকে বাংলাদেশে বিক্ষিপ্তভাবে ইন্ডিয়া আউট বা বয়কট ইন্ডিয়ান প্রডাক্ট আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। বাজারে, বিশেষ করে সুপারশপে অনেকেই ভারতীয় পণ্য কিছুটা বর্জন করছে, ভারতের পণ্যের এজন্য কিছু প্রোমোশনাল অফার চলছে, টিভিতে বিজ্ঞাপনও বাড়ছে। ব্যাপারটা হলো, বর্তমান সরকারকে শেষ কয়েকটা ভোট সাহায্য করা ছাড়াও বিভিন্ন সমস্যার কোনো সমাধান না করে উল্টো নিজেদের সুবিধা বুঝে নেওয়া, এটা অনেকেই পছন্দ করছে না। তবে এটা স্যাংশন না, স্রেফ বয়কট। যার পছন্দ সে কেনে যার পছন্দ না, কোনো কথা না বলে অন্য পণ্য কেনে। এই আন্দোলন বড় হলে বাংলাদেশের ট্রেডিং ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বড় উৎপাদনকারীরা নিজস্ব পণ্য বাজারজাতকরণের বড় সুযোগ পাবে। ভারতের চোখে চীন আউট যুক্তিসঙ্গত ব্যাপার, মালদ্বীপের ইন্ডিয়া আউট ফৌজদারি অপরাধ, তাদের মালদ্বীপ বয়কট একটা সম্মানজনক ব্যাপার, আবার বাংলাদেশের ইন্ডিয়ান পণ্য বর্জন একটা গর্হিত ব্যাপার। তারা নিজেদের সুবিধার কথা চিন্তা করে, কারণ বাজারের দখল বেশি দরকারি। ভারতের সামাজিক মাধ্যম ও টিভি চ্যানেলে ঝড় চলছে, এই সাইলেন্ট আন্দোলন টিভিতে আসছে, বাংলাদেশ সরকার কেন তাদের ভাষায় এই বিএনপি জামায়াতের কর্মসূচি বন্ধ করছে না, কতো বড় ক্ষতি হবে যদি তারা পণ্য না দেয় এসব নিয়ে কথা চলছে। আমাদের দেশের প্রিন্ট মিডিয়া ও টিভি মিডিয়া এ ব্যাপারে কথা বলার অনুমতি পায়নি। সরকারের অনুমতি ছাড়া কথা বলতে পারে না, বাসস যতোক্ষণ না বলবে তাদের সরকারের বিজ্ঞাপনের উপর ভরসা রেখে চুপ থাকতে হবে। ছোট করে বলার চেষ্টা করেছি। আমার ধারণা এই বয়কট অনেকেই মনে মনে সমর্থন করছে। অনেকে হয়তো বিকল্প দেশি বা অন্যদেশি পণ্য বেশি দামে কিনছে। এটা একটা বিরাট সুযোগ যা ভারত ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত করেছিলো, দেশীয় উদ্যোক্তা ও দেশিয় পণ্যে জনগণকে অভ্যস্ত করা। আমাদের উদ্যোক্তা তৈরির একটা সুসময়, যদি মানসম্মত পণ্য আর প্রচারণা ভালো করতে পারে, ভারতের অনেক পণ্য আসা কমে যাবে, সেখানে তারা বাংলাদেশে তাদের ফ্যাক্টরি খুলে পণ্য তৈরির কাজ শুরু করতেই পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সরকারের স্যাংশনকে সমর্থন করি, তবে কোনো সামাজিক বয়কটের পক্ষে না। কেউ নিজ থেকে কিছু করলে ঠিক আছে, তবে বয়কট প্রোমোট করার পক্ষে না।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক