বৃষ্টিভেজা কুয়াশা ঢাকা মধ্যরাতে মিসিসিপি নদীর ঘাট
মিরাজুল ইসলাম
২০২২ সালে নিউ অর্লিয়েন্স ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ ছিলো বৃষ্টিভেজা কুয়াশা ঢাকা মধ্যরাতে মিসিসিপি নদীর ঘাট। নিউ অর্লিয়েন্সে জ্যাকসন স্কয়ারের সেই এলাকাটি কুখ্যাত কিংবা বিখ্যাত হয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাস ব্যবসার ইতিহাসের কারণে। ১৭১৮ সাল থেকে আফ্রিকার মানুষদের কেনা-বেচা প্রথা চালু হবার পর ১৭১৯ সালে আফ্রিকার বিভিন্ন স্থান থেকে ৪৫১ জনকে অপহরণ করে দুইটি জাহাজে সর্বপ্রথম এই ঘাটে আনা হয়। তখন থেকে লুজিয়ানার নিউ অর্লিয়েন্স সূত্রে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে ট্রান্সআটলান্টিক ক্রীতদাস ব্যবসার সূত্রপাত। পরবর্তী সময়ে মিসিসিপি নদীর পাড়ে এমন একাধিক ঘাটে স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ এবং মার্কিন শাসনের অধীনে বারো হাজার ক্রীতদাস বেচা-কেনার দলিল পাওয়া যায়। যদিও মূল সংখ্যাটি ছিল বহুগুণ বেশি। ১৮০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রীতদাস ব্যবসা আইনগতভাব নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু নিউ অর্লিয়েন্সের এই ঘাটে ক্রীতদাস বোঝাই সর্বশেষ জাহাজটি নোঙর ফেলেছিলো ১৮৩০ সালে। পরবর্তী সময়ে শত বছরে এই কালো মানুষরাই নিউ অর্লিয়েন্সের সাংস্কৃতিক মানচিত্র বদলে দিয়েছে। শহরটি ক্রমে পরিণত হয়েছে শিল্পীদের আখড়ায়।
১৮৭২ সালে ফরাসি ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী এদগার দেগা পাঁচ মাসের জন্য প্যারিস থেকে এই শহরে বেড়াতে এসেছিলেন। এঁকেছিলেন কয়েকটি বিখ্যাত ছবি। নিউ অর্লিয়েন্স মিউজিয়ামে দেখেছিলাম দেগার জন্য আলাদা কক্ষ বরাদ্দ করা আছে। বর্তমানে স্প্যানিশ-ফ্রেঞ্চ-লাতিন-কৃষ্ণাঙ্গ সবার আশ্রয়ে নোলা (নিউ অর্লিয়েন্সের সংক্ষিপ্ত নাম) এখন গানের শহর, ফূর্তির শহর। সারা পৃথিবী এখন জানে, বিখ্যাত জ্যাজ সঙ্গীতের জন্মভূমি এই মিসিসিপি ঘাট থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরে। ১৭১৮ সাল নিউ অর্লিয়েন্স শহরটির জন্মসাল উল্লেখ করা হলেও আদতে এলাকাটিতে প্রাণের সঞ্চার ঘটে ১৭৯০ সাল থেকে। কারণ ততোদিনে তৈরি হয়ে গেছে ‘ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার’ নামের নতুন আবাসস্থল। এটি যেন নিউ অর্লিয়েন্সের ‘পুরান ঢাকা’। জ্যাজ মিউজিক ঘরানার জন্মস্থান হিসেবে সুপরিচিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর আদল অপরিবর্তিত রেখে জায়গাটি ‘আইনসিদ্ধ-নিষিদ্ধ’ যাবতীয় আনন্দ-উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। রক্কো ও নিও-ক্ল্যাসিজম ঘরানায় পুরানো ধাঁচের ব্যালকনি দেওয়া হেরিটেজ বিল্ডিং, বিভিন্ন স্বাদের খাবার, লাইভ মিউজিক ক্যাফে, আর্ট গ্যালারি, স্ট্রিপ ক্লাব, ক্যাবারে নৃত্যশালা ইত্যাদি নানাবিধ আয়োজনে মার্কিনীদের চোখে ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার এককথায়Ñ যাদুবাস্তবতা।
দিনে এবং রাতে ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের দুই রূপ। তবে কোভিডের জন্য ধুঁকছিলো পুরো এলাকাটি। জ্যাজ মিউজিক ক্যাফে আর সাধারণ মিউজিক ক্যাফেগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। যার জন্য গভীর রাত অব্দি ক্যাফে আর পানশালাগুলো খোলা ছিলো না। সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ে আয়োজনের সীমাবদ্ধতা আন্দাজ করা যায়। ফুটপাতে হোমলেস মানুষদের গড়াগড়ি। কিছু জায়গায় গাঁজা-মূত্রের দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ইচ্ছে ছিলো ভোর রাত পর্যন্ত জ্যাজ শুনবো। কিন্তু কেভিড পরিস্থিতির কারণে হলো না। মহামারী বদলে দিয়েছিলো রাতের ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের ঐতিহ্যবাহী চালচিত্র। এর মধ্যে মাঝহার ভাই সূত্রে দেখা হয়ে গেলো কিংবদন্তি জ্যাজ শিল্পী লুই আর্মস্ট্রং যে ক্যাফেতে নিয়মিত বাজাতেন সেই জায়গাটি। বারবন স্ট্রিটে কয়েকটি মিউজিক ক্যাফেতে ঢুঁ মেরে বোরিং লাগলো। ইলেকট্রিক গিটার বেসুরো লাগছিল। বেশি হট্টগোল। তার চেয়ে নিস্তব্ধ গলি পথে হেঁটে বেড়ানো রোমাঞ্চকর। একটা লিকার শপ খোলা পেলাম। লুসিয়ানার জনপ্রিয় পানীয় ফ্রোজেন ডাকরি পরখ করলাম। বরফ শীতল মার্গারিটা পান করতে হয় ধীরে-সুস্থে। তাই প্লাস্টিকের গ্লাস হাতে হাঁটতে বের হলাম। চুমুক দিতে দিতে রাতের রূপ দেখবো।
এভাবে ক্যানাল রোড ঘুরে সেন্ট লুই ক্যাথিড্রাল হয়ে জ্যাকসন স্কয়ারে মিসিসিপি ঘাট পর্যন্ত উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হেঁটে বেড়ালাম। দেখলাম ওই এলাকার অতি পরিচিত ক্যাফে ‘দু মন্দ’ রাত দশটায় বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ সারা রাত খোলা থাকার জন্য ক্যাফেটি বহুল আলোচিত। ১৬০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী কফি শপটি তার শত বছরের ইতিহাসে প্রথম নিয়ম ভঙ্গ করেছিলো ২০০৫ সালে। ক্যাটরিনা ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাফেটি দুই মাসের জন্য বন্ধ ছিলো। এর আগে এক সেকেণ্ডের জন্য এটি বন্ধ ছিলো না। মধ্যরাতে বন্ধ হয়ে গেছে কোভিডের কারণে। অবশ্য আফসোস হয়নি। বৃষ্টির ছাঁটে মার্গারিটার গ্লাসে অল্প চুমুকই যথেষ্ট ছিল। মধ্যরাতে আমার একাকী হাঁটাচলার কিছু ছবি তুলেছিলেন ভ্রমণ-সঙ্গী মাঝহার ভাই। তখনই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম সেই বিমূর্ত রাতের একটা ছবি আঁকতে হবে। সেন্ট পলে ফিরে চলতি পথে দেখা এক্সপ্রেশনিস্ট-ফভিস্ট শিল্পী প্যাসিন-স্যুটিন-মাতিসদের কথা ভুলতে পারি না। একসময় ঘোর লাগা মন নিয়ে স্কুল অব প্যারিস গ্রুপের শিল্পীদের ঘরানায় অ্যাক্রেলিক মাধ্যমে এঁকে ফেললাম ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারে স্মৃতিমাখা রাতের কোনো এক বিশেষ মুহূর্ত। লেখক ও চিকিৎসক