নারীর ক্ষমতায়ন টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত
মো. মনির হোসেন : ‘পৃথিবীর সব মহান সৃষ্টির অর্ধেক নারীর আর অর্ধেক পুরুষের। কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই বাণী বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের আর্থ-সামাজিক
প্রেক্ষাপটে এক পরম সত্য। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত ও সভ্য দেশে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও অনেক অগ্রগতি প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নারী ও পুরুষের সমান অবদান রাখার বিকল্প নেই। আমাদের সমাজে এক সময় নারীদের প্রধান কাজ গৃহস্থালি ও সন্তান লালন-পালন হিসেবে বিবেচিত হলেও এখন সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। এখন নারীরা ঘরের বাইরের কাজে পুরুষের সমান অবদান রাখতে পারে। তবে নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ অর্থনীতিতে নারীর অবদান তুলে ধরতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। এতদসত্ত্বেও আমাদের দেশের নারীরা কর্মক্ষেত্র ও পরিবারে পুরুষের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া বা বাস্তবায়নের কাঙ্খিত সুযোগ পাচ্ছেন না। যা তাদের অধিকার। নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আমার আলোচনার মূল বিষয় হলো নারীর ক্ষমতায়ন ও কেন এটি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ডোমেইন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেখানে লিঙ্গ বৈষম্য ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, নারীর ক্ষমতায়ন রূপান্তরমূলক পরিবর্তন আনতে পারে যা টেকসই উন্নয়ন ও সামগ্রিক অগ্রগতিতে অবদান রাখে। এই প্রবন্ধটি বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের গুরুত্ব ও বিভিন্ন মাত্রায় এর প্রভাব অন্বেষণ করবে। বাংলাদেশ, একটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক দিকগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে ঐতিহ্যগত লিঙ্গ ভূমিকা ও পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক নিয়মগুলো অব্যাহত রয়েছে, যা দেশের উন্নয়ন যাত্রায় নারীদের পূর্ণ অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থানের সুযোগ ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে সীমিত প্রবেশাধিকার সহ অসংখ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন বাংলাদেশের উন্নয়নের একটি মৌলিক দিক।
নারীরা দেশের কর্মশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, বিশেষ করে কৃষি খাতে। তাদের প্রায়ই সম্পদ, ঋণ ও মালিকানার অধিকারের অভাব হয়, যা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের ক্ষুদ্রঋণ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যে উদ্যোগগুলো নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিতে আশাব্যঞ্জক ফলাফল দেখিয়েছে। দারিদ্র্যের চক্র ভেঙ্গে ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য নারী শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ অপরিহার্য। শিক্ষিত ও দক্ষ নারী রা অর্থনীতিতে অর্থপূর্ণভাবে অবদান রাখতে, উদ্ভাবন করতে ও বাজারের গতিশীলতার পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আরও ভালভাবে সজ্জিত। নারী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার মানব পুঁজির পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন চালাতে পারে।
বাংলাদেশে আরও ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন অপরিহার্য। ক্ষমতাপ্রাপ্ত নারীরা তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে, বৈষম্যমূলক অনুশীলনকে চ্যালেঞ্জ করতে ও লিঙ্গ সমতার পক্ষে সমর্থন জানাতে আরও ভালোভাবে সক্ষম। নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা মোকাবেলা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণের প্রচারের লক্ষ্যে উদ্যোগগুলো সামাজিক ক্ষমতায়ন অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মাতৃত্ব ও প্রজনন স্বাস্থ্য সহ স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাগুলোতে নারীদের প্রবেশাধিকার উন্নত করা তাদের ও তাদের পরিবারের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য অত্যাবশ্যক। স্বাস্থ্যসেবা অ্যাক্সেসের বাধাগুলো মোকাবেলা করা ও ব্যাপক প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা মা ও শিশু স্বাস্থ্যের ফলাফলগুলোকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে পারে ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনের প্রচারের জন্য ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীর কণ্ঠস্বর যাতে শোনা যায় তা নিশ্চিত করার জন্য নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন অপরিহার্য। কিছু অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও নেতৃত্বের পদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব কম। নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রচারের প্রচেষ্টা, যেমন কোটা ব্যবস্থা ও লক্ষ্যমাত্রা তৈরির কর্মসূচী, রাজনীতিতে লিঙ্গ বৈষম্য মোকাবেলা করতে ও নীতিনির্ধারণে বৃহত্তর লিঙ্গ সংবেদনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে।
রাজনৈতিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন আরও প্রতিক্রিয়াশীল ও জবাবদিহিমূলক শাসন কাঠামোর দিকে নিয়ে যেতে পারে যা লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের চাহিদা ও উদ্বেগকে অগ্রাধিকার দেয়। রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা সংস্কার ও স্বাস্থ্যসেবা বিধান সহ গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে মোকাবেলায় অনুঘটক করতে পারে।
বাংলাদেশের উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়নের গুরুত্ব ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হলেও উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। গভীর শিকড়যুক্ত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, সাংস্কৃতিক নিয়ম ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা লিঙ্গ সমতার অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যাতে সরকারি সংস্থা, সুশীল সমাজ সংস্থা, বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতা জড়িত। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সুবিধা বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও মোবাইল প্রযুক্তি উদাহরণস্বরূপ, নারী উদ্যোক্তা ও কর্মীদের জন্য তথ্য, আর্থিক পরিষেবা ও বাজারের সুযোগগুলোতে অ্যাক্সেস সহজতর করতে পারে। ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রোগ্রামে বিনিয়োগ ও ইন্টারনেট সংযোগ সম্প্রসারণ ডিজিটাল বিভাজন সেতুতে সাহায্য করতে পারে ও ডিজিটাল অর্থনীতিতে আরও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে নারীদের ক্ষমতায়ন করতে পারে।
নারীর ক্ষমতায়ন শুধুমাত্র ব্যক্তি ও পরিবারকে উপকৃত করে না বরং সামগ্রিকভাবে সমাজের সামগ্রিক সমৃদ্ধি ও কল্যাণে অবদান রাখে।
যেহেতু বাংলাদেশ তার উন্নয়ন যাত্রা চালিয়ে যাচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া একটি আরও ন্যায়সঙ্গত, সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতি গঠনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ফোকাস হতে হবে। সুতরাং এই পরিপ্রেক্ষিতে, টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি অনুঘটক হিসেবে নারীর ক্ষমতায়নের যথাযথ বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দিতে ও ফোকাস করার জন্য সরকারি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ