গার্মেন্টস, অটোমেশন ও ছাঁটাইয়ের বাস্তবতা
মাহা মির্জা
ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল একটা প্রতিবেদন করেছিল ২০১৮ সালে। ‘দ্য রোবটস আর কামিং ফর গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স’। প্রতিবেদনের সারমর্ম ছিল এমন: আগে ভাবা হতো বাংলাদেশের মতো সস্তা শ্রমের দেশে অটোমেশনের ঝুঁকি নেই। ভাবা হতো, বুননের কাজ, সেলাই-এর কাজ, লুপ বসানোর কাজ মেশিন দিয়ে সম্ভব না। তবে পরিস্থিতি বদলেছে। আগে ১০-১২ ঘন্টা কাজ করে সোয়েটার বুননের কাজ করতো শত শত শ্রমিক। এখন পুরো কাজটাই করছে নিটিং মেশিন।
তাহলে অটোমেশনের প্রভাবে ঠিক কত ছাঁটাই হতে পারে? খুব নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই আমাদের হাতে। তবে বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্ট বলছে ২০১৯ সালেই চাকরি হারিয়েছে প্রায় ৩০ হাজার গার্মেন্টস কর্মী, এবং এর বড় অংশই অটোমেশনের কারণে। বলা হচ্ছে, সিউ বোট (সেলাই করার মেশিন) সহজলভ্য হওয়ায় পোশাকখাতের একটি বিরাট অংশ ফেরত যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে। আশংকা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের শতকরা ৬০ ভাগ গার্মেন্টস কর্মীই চাকরি হারাবেন (ডেইলি স্টার, ২০১৯।) এদিকে ম্যাকেঞ্জি রিপোর্ট (২০১৭) বলছে, রোবোটিক অটোমেশনেরকারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৮০ কোটি মানুষ কর্মসংস্থান হারাবে।
উল্লেখ্য, একটা সময়ে বাংলাদেশে প্রতি বছরই ৩ লক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হতো শুধু এই গার্মেন্টস খাতেই (২০০৩ থেকে ২০১০সাল পর্যন্ত প্রায় টানা ৭ বছর এই হার অব্যাহত ছিল)। কিন্তু দেশের রেডিমেড গার্মেন্টস রফতানির পরিমান দিনে দিনে বাড়লেও পরবর্তী এক দশকে এই খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সংখ্যা নেমে এসেছে প্রায় ৬০ হাজারে (বিশ্বব্যাংক, ২০১৭)। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ২০১৩ থেকে ২০১৬পর্যন্ত পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বছরে বাড়ছিল প্রায় ২০ শতাংশ করে। অথচ একইসময়ে গার্মেন্টসের কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। অর্থাৎ রফতানি বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু নতুন চাকরি তৈরী হয়নি। অর্ডার বেড়েছে, কিন্তু শ্রমিকের কাজটা করছে স্বয়ংক্রিয় মেশিন।
বিশ্ব্যব্যাংকের ২০১৭ সালের প্রতিবেদন বলছে,”যিরষব ইধহমষধফবংযর বীঢ়ড়ৎঃবৎং ধৎব রসঢ়ৎড়ারহম ঃযবরৎ য়ঁধষরঃু ঢ়ড়ংরঃরড়হরহম রহ মষড়নধষ জগএ সধৎশবঃং, ঃযরং সধু হড়ঃ নব ঃৎধহংষধঃরহম রহঃড় মধরহং ভড়ৎ ড়িৎশবৎং রহ ঃবৎসং ড়ভ সড়ৎব লড়নং ধহফ যরমযবৎ ধিমবং. ঊারফবহপব ংঁমমবংঃং ভরৎসং সধু নব ংঁনংঃরঃঁঃরহম ঃবপযহড়ষড়মু ভড়ৎ ড়িৎশবৎংৃ ” (বিশ্বব্যাংক, ২০১৭)। অর্থাৎ গার্মেন্টস শিল্পে অটোমেশনের প্রভাব পড়া শুরু করেছে। এবং অদূর ভবিষ্যতে এই খাতে চাকরি হারানো শ্রমিকের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়বে।
গার্মেন্টস খাতে ব্যাপক অটোমেশনের প্রভাব কী? ছাঁটাইয়ের প্রভাব কী? গার্মেন্টস ৪০ লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরী করেছে এটুকু আমরা সবসময় শুনি। কিন্তু ছাঁটাইয়ের পর গার্মেন্টস কর্মীরা কি গ্রামে ফেরত যান? নাকি শহরের ভ্যান চালক হয়ে যান? ক্ষয়িষ্ণু গ্রামীণ অর্থনীতি কি তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারে? নাকি তারা শহরের ইনফরমাল অর্থনীতির কোনো একটি ‘টেম্পোরারি’ কাজের মধ্যে ঢুকে যান? এই বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণা আমাদের হাতে নেই।
অটোমেশনের এই জটিল বাস্তবতায় শুধু একটি খাতকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভটি গড়ে ওঠার বিপদগুলো নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা কি আমাদের সতর্ক করেছেন? ২০২০ সালে কিন্তু একটি সুযোগ এসেছিলো রফতানি শিল্পের ওপর আমাদের একচেটিয়া নির্ভরশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আমাদের অর্থনৈতিক পলিসি কী হবে, নতুন ধরনের কর্মসংস্থান কীভাবে তৈরি হবে, অর্থনীতির বৈচিত্রকরণটা কোন উপায়ে হবে, স্থানীয় শিল্পের বিকাশে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপগুলো কী কী হবে, এসব জরুরি আলোচনাগুলো শুরু করার প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েছিল। কিন্তু গোটা মহামারীর সময়টাতেই গার্মেন্টসের ‘অর্ডার’ সর্বস্ব আলোচনার সীমাবদ্ধতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
গার্মেন্টস না থাকলে কি আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো? গার্মেন্টসের কি কোনো বিকল্প আছে? এক্সপোর্ট না করলে আমাদের অর্থনীতি টিকবে কি করে? অর্থনীতির আলোচনায় এই প্রশ্নগুলো নতুন কিছু নয়। তবে বিকল্প অর্থনৈতিক চিন্তার জগৎটি অনেক আগের থেকেই সমৃদ্ধ। আগেই বলা হয়েছে দেশ বিদেশের বহু ‘প্রগ্রেসিভ’ অর্থনীতিবিদ এক্সপোর্ট-সর্বস্ব অর্থনীতির বিকল্প নিয়ে আলাপ করেছেন। স্থানীয় অর্থনীতির বৈচিত্র এবং গুরুত্ব নিয়েও আলাপ করেছেন। কিন্তু আমাদের মূলধারার অর্থনৈতিক আলোচনায় আমরা তার প্রতিফলন দেখিনি। আমাদের অর্থনীতির বয়ান থেকে কৃষক বাদ পড়ে গেছে, পোল্ট্রি ডেইরি বাদ পড়ে গেছে, কয়েক কোটি সৃজনশীল মানুষের একটা গোটা ইনফরমাল অর্থনীতিও বাদ পড়ে গেছে। লেখক: রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষক। লেখাটি সংক্ষেপে সর্বজন কথা থেকে নেয়া।