টাঙ্গাইল শাড়ি মানে বাংলাদেশেরই শাড়ি
ফরিদা আখতার
আমি ও আমার সহকর্মিরা গত ৫ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইলে ‘‘তাঁত ব্যবসায়ী সমিতি”র বসাক সদস্যদের সাথে দেখা করি। প্রবর্তনার কারণে এখানকার বসাকদের সাথে আমাদের সম্পর্ক খুব ভাল। আমাদের সাথে কথা বলার জন্যে সেখানে ছিলেন সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক এবং অন্যান্য গুরুত্বপুর্ণ সদস্যরা যেমন গোবিন্দ বসাক, রতন বসাক, সুশীল বসাক, নিমাই বসাক, কৃষ্ণ বসাক ও বলরাম বসাক। এক আন্তরিক পরিবেশে তাঁদের সাথে কথা বার্তা হোল। এবং এই আলোচনায় যেসব বিষয় উঠে আসলো আমাদের সবারই জানা দরকার।
অবশ্যই আলোচনার মধ্যে প্রধানতঃ ভারতের (পশ্চিমবঙ্গ) দাবি নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছিল। টাঙ্গাইল থেকে অনেক বসাকরা ওদের দেশে চলে গেছে, সেখানে তারা তাঁতের শাড়ি বুনছে, কাজেই এই শাড়ীকে তারা টাঙ্গাইলের শাড়ি দাবি করবে এতা তাঁরা মানতে রাজী নন। যারা ওপারে গেছে তারা তো টাংগাইলের মাটি নিয়ে যেতে পারে নাই। টাঙ্গাইলের পরিবেশ তো নিয়ে যেতে পারে নাই!! যারা গেছে তারা তাদের দক্ষতা নিয়ে গেছে। তাহলে যে তাঁতীরা সেখানে শাড়ি বুনছে সেই এলাকার নাম দিতে পারে, টাঙ্গাইল কেন? আমাদের আপত্তি তো সেইখানে। টাঙ্গাইল যে একটা জেলার নাম সেটাও তারা জানে না।
নিমাই বসাকের প্রশ্ন ছিল আমরা যে এতোদিন আবেদন করলাম না এটা কি আমাদের ব্যর্থতা নয়? অবশ্যই, এটা ব্যর্থতা। এবং শুধু ব্যর্থতা নয়, গাফিলতিও। এতবড় একটা সম্পদ- টাঙ্গাইল শাড়ি, এটা তো আমাদের গাফিলতির কারনে হারিয়ে যেতে পারে না। নিমাই বসাক বীরেন বসাকের প্রসঙ্গ তুললেন। বিশেষ করে তার দাবি যে সে ভারতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে গেছে, অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে ১৯৬১ – ১৯৬৫ সময়ে গেছে। অতএব সে বাংলাদেশ থেকে যায় নাই। এক বছর আগে, ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর রঞ্জন বসুর লেখা ‘টাঙ্গাইল শাড়ী তুমি কার? বাংলাদেশ না পশ্চিম বঙ্গের ?’ শিরোনামে একটি লেখায় বীরেন বসাকের কথা আছে। তিনি বর্তমানে ফুলিয়ায় সবচেয়ে বিখ্যাত শাড়ির দোকানের কর্ণধার ও ভারত সরকারের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত শাড়ি-শিল্পী। বীরেন কুমার বসাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, ‘আমরা বসাকরা হলাম জাতে তাঁতি। আমাদের আদি নিবাস টাঙ্গাইলে, ছোটবেলা থেকে সেখানে বাজিতপুরের হাটে শাড়ির কেনাবেচা দেখে আসছি, যেখানে কলকাতা-বোম্বে-দিল্লি থেকেও মহাজন আর ব্যাপারিরা আসতেন। টাঙ্গাইলের শিবনাথ স্কুলে পড়তাম, যেখানে কাদের সিদ্দিকী ছিলেন আমার দু’বছরের সিনিয়র। সেই সব ছেড়েছুড়ে বাষট্টি সালে ফুলিয়াতে যখন চলে আসি, তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি।’
বীরেন কুমার বসাক মনে করেন, খোদ টাঙ্গাইলের চেয়েও এখন ফুলিয়াতেই অনেক বেশি ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ তৈরি হয় – সে কারণেই সম্ভবত এটাকে ফুলিয়ার প্রোডাক্ট হিসেবে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু তিনি সেই সঙ্গেই বলছেন, ‘আসলে এটাকে এখন ফুলিয়ার শাড়ি নামেই পরিচিত করানোর সময় এসেছে – এটাকে টাঙ্গাইল শাড়ি বলার কোনও অর্থই হয় না।’ অথচ ভারত সরকার এটাকে টাঙ্গাইল শাড়ী নামেই জিআই স্বীকৃতি দিল। তার মানে ভারত সরকারের নজর শুধু শাড়ীর দিকে নয়, টাঙ্গাইলের দিকেও ছিল। বীরেন বসাক এখন কি বলছেন আমরা জানি না, কিন্তু আমি মনে করি তার দিক থেকেও প্রতিবাদ আসা উচিত। টাঙ্গাইলের বসাকরা বীরেন বসাকের ভুমিকায় খুশি নন।
টাঙ্গাইলের বসাকদের এই যে দাবী এটাকে উপেক্ষা করা কোন মতেই সম্ভব না। আমাদের সবার বক্তব্য ছিল , এখন তাড়াতাড়ি কাজ করতে হবে। যদি দেরী করি তাহলে ঐতিহাসিকভাবে ক্ষতি হয়ে যাবে। আগামি প্রজন্ম আমাদের অভিশাপ দিবে। তবে গত ৩০ জানুয়ারি, ২০২৪ টাঙ্গাইলের ডিসি কায়ছারুল ইসলাম রঘুনাথ বসাক সহ সবাইকে ডেকেছিলেন। টাঙ্গাইলের শাড়ীর জিআই নেয়ার আলোচনার জন্য। আজকের পত্রিকা (৮ ফেব্রুয়ারি) জানা গেল শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)র পক্ষ থেকে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা এই কাজটিতে ভুমিকা রেখেছেন।
রঘুনাথ বসাক কথা প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল শাড়ীর একটি ইতিহাস তুলে ধরেন। দুইশো বছরের টাঙ্গাইলের শাড়ির ইতিহাস। বসাকদের শাড়ি বুননের প্রয়োজনীয়তা আগে যাচাই করতে হয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন জেলায় ঘুরেছেন। যেমন প্রথমে কিশোরগঞ্জ, তারপর ঢাকা, ধামরাই, চৌহাট, তারপর হলো টাঙ্গাইল। এ পর্যন্ত কিন্তু তাঁত বুনছে সবাই। সেই শাড়িগুলার নাম কিন্তু টাঙ্গাইল শাড়ি ছিল না। বসাকদের কিছু অংশ এখনও চাঁপাইনবাবগঞ্জে রয়ে গেছেন।
তাঁতের সুতি শাড়ির জন্যে যে আবহাওয়াটা দরকার এই আবহাওয়াটার খোঁজেই তাঁত শিল্পীরা ঘুরতো। ঘুরতে ঘ্রুতে কিছু অংশ চলে গেল কিশোরগঞ্জ আর কিছু অংশ চলে গেল ঢাকায়। এ সব জায়গা টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরীর উপযুক্ত জায়গা না। ঢাকাও টাঙ্গাইল শাড়ির করার উপযুক্ত জায়গা না। ঢাকা মসলিন তৈরীর উপযুক্ত জায়গা। কিন্তু সুতি কাপড় তৈরীর জায়গা না। বসাকদের কিছু প্রজন্ম চলে যায় ধামরাই। সেখান থেকে চলে যায় চৌহাট বাওখন্ড নামে এক জায়গায়। তারা দুই জায়গায় অবস্থান করলো। দুই জায়গায়ই তাঁরা সুতি শাড়ি করার আবহাওয়া খুঁজে পেলো না। তারপর তারা যাযাবরের মত এদিক ওদিক ঘুড়তে থাকে। শেষে এই টাঙ্গাইলে এসে পড়ে। এখানে বড় নদী আছে ধলেশ্বরী। তখন তারা এখানে এসে আস্তানা নিলো।
তারপর এখানে শাড়ি বানানো শুরু হয়। তখন দেখা গেল এখানে ধলেশ্বরী নদীর আবহাওয়ার সাথে সুতি কাপড় তৈরীর একটা ভাল পরিবেশ আছে। এই সংমিশ্রনটা খুব ভাল হয়। তখন থেকে টাঙ্গাইল সুতি শাড়ি বানানো শুরু হলো। এবং তখন থেকেই নাম হলো “টাঙ্গাইল শাড়ি”। এটাই ২০০ বছরের উপরে টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাস। তখন থেকে এই শাড়ির নাম হলো টাঙ্গাইল শাড়ি। একনাগারে শাড়ির ইতিহাস বলে রঘুনাথ বসাক যোগ করেন, “আমার বাপ, ঠাকুরদা তো এই টাঙ্গাইল শাড়িই বানিয়েছেন”।
টাঙ্গাইল শাড়ির একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাড় দেয়া। রঘু বসাক জানালেন ‘আমরা পোড়া বিন্নি ধানের খৈ দিয়ে মন্ড তৈরী করে শাড়িতে মাড় দেই। বিন্নি ধান আঠালো। তাতে শাড়ি গ্লেস দেয়। আবার কেউ পোখরাজ ধানের খৈ দিয়েও দেয়। এখন অতো বিন্নি ধান পাওয়া যায় না। এখন কিছু বিন্নি ধানের সাথে ভাত মিশায়ে শাড়িতে মাড় দেওয়া হয়। সে ধানগুলোও সুন্দরভাবে এই এলাকায় হতো। বিন্নি ধানের মন্ডের সাথে কিছু ঝিনুকের চুন মিশ্রন করে শাড়িতে মাড় দেওয়া হতো। ঝিনুকও আমাদের এখানে পাওয়া যেতো। এখন পাওয়া যাচ্ছে না। এখন কৃত্রিম চুন ব্যবহার করতে হচ্ছে। আবার কেউ কেউ খরচ বাঁচানোর জন্য ভাতের মাড় দিচ্ছে। নিয়ম হচ্ছে- নারোদে শাড়ি মাড় দিতে দিতেই শুকাতে হবে। সেই শাড়ি ভাল হবে, গ্লেস দিবে। নারোদে শাড়ি পেচানোর পরে শুকাতে তো অনেক সময় লাগবে!! শাড়ি নারোদে থাকা অবস্থায় শাড়িতে মাড় দিতে হয়। দুঃখজনক হচ্ছে বিন্নি ধানের অভাবে কেউ কেউ এরারুট দিয়ে শাড়িতে মাড় দেয়।
রঘুনাথ বসাক এবং অন্যান্য যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের এক কথা। ধরেন আমার পরিবার নিয়ে রাজশাহীতে বসবাস করলাম। সেখানে তাঁতে শাড়ি বানালাম – তাহলে কি সেটা টাঙ্গাইলের শাড়ি হবে? সেটা রাজশাহীর শাড়ি হবে। পশ্চিম বঙ্গে যে ফুলিয়ার শাড়ি হচ্ছে – সেটা তো ফুলিয়ার শাড়ি, টাঙ্গাইলের শাড়ি না। শাড়ি যেখানেই তৈরী হোক সেটা শাড়ি কিন্তু সেটা টাঙ্গাইলের শাড়ি হবে না। এটাই আমাদের গর্ব, টাঙ্গাইল শাড়ির গর্ব।
রঘুনাথ বসাক শেষে বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা ছোট গল্পের একটা ডায়ালগ মনে পড়লো “এক ফাঁসির আসামি শেষ রাতে বসে বসে কাঁদছে। যে গার্ড ছিল ও গিয়ে ডাকছে, ওঠ, ওঠ কাঁদছিস, কাঁদছিস কেন? ও হ্যাঁ তুই কাঁদবি তো। কাঁদতে তো তোকে হবেই। কাল সকালে তোকে ফাঁসির দঁড়িতে ঝুলানো হবে। পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাবি। মাটির সাথে যে তোর নাড়ির সম্পর্ক। কাঁদতে তো তোকে হবেই। মাটির সাথে যে তোর নাড়ির টান!! নাড়ি ছিড়ে চলে যাবি।” তেমনি টাঙ্গাইল শাড়ির সাথে আমাদের নাড়ির টান। আর টাঙ্গাইল শাড়িরও আমাদের সাথে নাড়ির টান। আমাদের প্রত্যেকটা লোকের মনে আঘাত লাগছে।
শুধু বসাকরা নয়, এই শাড়ির ব্যবহারকারীসহ সকলেই একইভাবে অন্তরে আঘাত অনুভব করছেন। আমাদের দেশের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা আমাদের অস্তিস্ত্বের প্রশ্ন। ছাড় দেওয়া যাবে না কিছুতেই। ভারতে যে প্রতিষ্ঠান টাঙ্গাইল শাড়ির নামে জিআই নিয়েছে তার বিরুদ্ধে আমাদের আপিল করতে হবে, টাঙ্গাইল নামে তারা রাখতে পারবে না। টাঙ্গাইল শাড়ি মানে বাংলাদেশেরই শাড়ি। এই বক্তব্য আমাদের পরিস্কার এবং দৃঢ় থাকতে হবে- টাঙ্গাইলের শাড়ি আমাদের। লেখক: নির্বাহী পরিচালক উবিনীগ। [ফেসবুক থেকে নেয়া]