ব্যাংক খাতের মার্জার, এক্যুইজিশন এবং ট্রেডিশনাল ব্যাংকিং
কাজী এম. মুর্শেদ
যে কথাটা বলে আসছিলাম দেরীতে হলেও সরকার এখন এটা নিয়ে কথা বলছে। ব্যাংক খাতের মার্জার ও এক্যুইজিশন নিয়ে। আমাদের জনসংখ্যা, এলাকা, ট্রাডিশনাল ব্যাংকিং, শরীয়া ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, এসএমই ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং আসন্ন ডিজিটাল ব্যাংকিং হিসাব করলে ৩০-৩৫টা ব্যাংকই যথেষ্ট। সেখানে প্রায় ৬৮টা ব্যাংক আছে। এর মধ্যে অনেকগুলো বিশেষায়িত ব্যাংক যেমন প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক যেমন আছে, তেমনি কিছু বাহিনী নির্ভর ট্রাস্ট ব্যাংক, আনসার ভিডিপি ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক আছে। এর বাইরে কিছু ব্যাংক পুরোপুরি রাজনৈতিক ইচ্ছায় করা পদ্মা ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংক ইত্যাদি। দেশের বর্তমান আর্থিক খাত হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের সাথে দেশী মুদ্রার লিকুইডিটি ক্রাইসিস যেমন বিদ্যমান, তেমনি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল করে ঋণ কম দেখানো, অথবা খেলাপি ঋণ শোধ করতে নতুন ঋণ দিয়ে বোঝা বাড়ানো অন্যতম। এর সাথে যোগ হয়েছে টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিয়ে সেখান থেকে ঋণ নিয়ে সরকারি খরচ চালানো।
ওভারঅল, ব্যাংকগুলো একীভূত করার কোনো বিকল্প নেই। কারণ বলছি। আমার কথা ছিলো, প্রতিটা মোটামুটি সবল ব্যাংক যার যথেষ্ট এ্যাসেট আছে, তারা একটা করে দুর্বল ব্যাংককে নিয়ে নিলে খরচ কমানো সম্ভব। মোট ব্যাংকের সংখ্যা অর্ধেক করা সম্ভব, শুধু ইচ্ছা থাকতে হবে। ইচ্ছা হলো, এটা মার্জার হবে নাকি এক্যুইজিশন হবে। দুটোর পার্থক্য হলো মার্জারে দুই ব্যাংকের মালিকানা এক হয়ে যায়। দুইটার বোর্ড একটা হয়ে আসে যেখানে দুইপক্ষের স্পন্সর ডিরেক্টর থাকে। আর এক্যুইজিশন অর্থ একটা ব্যাংককে পুরোটাই নিয়ে নেয়। এতে একটা ব্যাংকের অস্তিত্ব থাকে না। তাদের এ্যাসেট, লায়াবিলিটি অন্য ব্যাংকের অধীন হয়ে যায়। যে ব্যাংক কিনছে তাদের বোর্ড অফ ডিরেক্টর থাকে।
এই একীভূতকরণের কথা বাংলাদেশ গভর্নর বলেছিলেন। যদি ব্যাংক সংখ্যা ৪৫ এ আনা যায়। একইভাবে অর্থমন্ত্রী বললেন। দেরীতে হলেও কাজটা করা উচিত। যেখানে খরচ বাঁচে সেটা বলি। দুর্বল বা সবল ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা যাই হোক, ম্যানেজমেন্ট খরচ সবার সমান, যা বেশ খরচের। যখনই একীভূত হবে বিশাল মাথামোটা খরচ একদিকে কমে যাবে। দ্বিতীয়ত যে লাভ হবে, একই এলাকায় দুই ব্যাংকের আলাদা ব্রাঞ্চ দরকার নেই। এতে জায়গা এবং লোক কমানো সহজ। তবে এলাকা ভেদে কোনো এলাকায় অতিরিক্ত সময় খোলা থাকতে পারে। যেমন খাতুনগঞ্জ, চকবাজার, বংশাল, কারওয়ানবজার ইত্যাদি। সুবিধার কথা বললাম, সমস্যাও আছে। সবল ব্যাংক কেনো দুর্বল ব্যাংক কিনবে যার গুডউইল ভালো না বা লায়াবিলিটি অনেক বেশি। কিছু ব্যাংকের অবস্থা এতোই খারাপ যে ৯০-৯৫ শতাংশ খেলাপি ঋণে উঠেছে। এগুলো মন্দঋণ হিসেবে মোছা যাচ্ছে না। অথচ ওই ব্যাংকগুলোর লিক্যুইডিটি ক্রাইসিস বা তারল্য সংকটের পরও ম্যানেজমেন্ট টিম ঠিকই বড় খরচের বেতন নিয়ে চলে। উদাহরণ দিতে পারতাম, আর নাম বললাম না। আর যদি একান্তই না করতে পারে, খোদ আমেরিকায় এই ব্যবস্থা চলছে, সেই আমেরিকায় ব্যাংক দেউলিয়া হয়।
গত বছরে কম করে তিনটা ব্যাংক অবলুপ্ত হয়েছে। আমাদের না হলেও হতে কতোক্ষণ? তখন আমানতকারীদের স্বার্থ কে দেখবে? আমার প্রথম এই ব্যাপারে লেখা কবে তা মনে নেই, সম্ভবত আট বা দশ বছর আগে হবে। সেই কথাটা বুঝতে এতো বছর লাগলো। তারপরও যদি বাস্তবায়ন করে সেটা ভালো উদ্যোগ হবে। আমার ধারণায় কিছু ব্যাংক আর্থিকভাবে এতো শক্ত অবস্থানে আছে যারা তিনটা বা চারটা ব্যাংকেও কিনে নিতে পারে। অনেকটা এক ব্যাংকের সাথে মার্জার করে বাকি তিনটা ব্যাংক এক্যুইজিশন করা। এতে পাঁচটা ব্যাংক থেকে একটা ব্যাংক দাঁড়াবে। যখন কাজ একই করে তখন সংখ্যা বাড়ানো অপ্রয়োজনীয়। সব ব্যাংকই একই ধরনের কাজ করছে। একীভূত না করার কারণ নেই। একই সাথে খাতা কলমে ৩৪টা টিভি চ্যানেল আছে সেগুলোও একীভূত করে সংখ্যা কমানো সম্ভব।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক