প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টে প্রয়োজনীয় বাধাগুলো পর্যালোচনা ও অপসারণ প্রয়োজন
ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী : প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) জাতীয় উন্নয়নে বাংলাদেশের মতো সম্পদ-সংকল্পিত দেশের জন্য একটি দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করে। ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি ইউএসএআইডি-এর মিশন ডিরেক্টর রিড জে এশলিম্যান সম্প্রতি এই মত প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা রয়েছে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও জ্বালানির মতো খাতে এফডিআইয়ের সুযোগ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দুর্নীতি সবচেয়ে বড় বাধা। আমাদের প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বিষয়টিকে মোটেও অতিরঞ্জিত করেননি। আসলে অনেক সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেই দুর্নীতির প্রাধান্য রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এই বিবৃতিটি অস্বীকার করার কিছু নেই। আর, এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বেসরকারি খাতকে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সম্ভাবনার তুলনায় খুবই কম। বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সেবা পেতে অবশ্য বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতির সম্মুখীন হতে হয়। যে কারণে এদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা পূর্ণাঙ্গভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। দেশটির বিভিন্ন খাতে এফডিআই বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সম্ভাব্য সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এফডিআই আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় বাধাগুলো পর্যালোচনা করা, অপসারণ করা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিশেষ উপযোগী পরিষেবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিনিয়োগবান্ধব আইন বা নীতি প্রণয়ন হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিদ্যুতের পরিকাঠামো স্থিতিশীল হারে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এটি এখনও পর্যন্ত চ্যালেঞ্জিং রয়ে গেছে। বিভিন্ন সেবা প্রদানের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিসও চালু করা হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। কোভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এনার্জি কমোডিটির দাম তেজি ছিলো। তার উপরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় সমগ্র বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বড় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। এই উত্তেজনার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়ে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাম্প্রতিক বিনিয়োগ জলবায়ু প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সীমিত অর্থায়নের সুযোগের মতো বেশ কয়েকটি কারণ বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা তৈরি করছে। বাংলাদেশ সরকারও স্বীকার করেছে যে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে তবে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে।
অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে নিবন্ধন করেন। আবার তাদের মধ্যে খুব কমই শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বাংলাদেশে নিবন্ধিত বিদেশি বিনিয়োগের এক তৃতীয়াংশও কার্যকর নয়। অনেকেই ঝামেলায় জর্জরিত হয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। সরকারের উচিত এর পেছনে প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করা যাতে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাওয়া যায়। অর্থনৈতিক নীতির পরিপ্রেক্ষিতে, সরকার দ্রুত সুনির্দিষ্ট সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে এবং সবার জন্য একটি উন্মুক্ত বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন করছে। যেখানে সরকারের ভূমিকা হবে অনুঘটকের মতো, নিয়ন্ত্রকের নয়। এটি একটি বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশের জন্য সত্যিই স্বাস্থ্যকর।
শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা, যৌক্তিক শুল্ক এবং রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অর্জন সাধিত হয়েছে। শুল্ক কাঠামো ও আমদানি নীতির বিভিন্ন দিককে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের অভিমত এই দেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের অনেক সুযোগ রয়েছে, যেমন অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য, ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদন, টেক্সটাইল এবং চামড়া, অটোমোবাইল এবং হালকা প্রকৌশল, কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং তেল, গ্যাস ও সামুদ্রিক খাত। যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় আইনের দ্রুত প্রয়োগের অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অত্যধিক বিলম্ব, দুর্বল অবকাঠামো এবং গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, জমির স্বল্পতা এবং ক্রয় করতে অসুবিধা, বড় ঋণ প্রদানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অক্ষমতা ও অভাব। স্থানীয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সংযোগ ও সমন্বয়ে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
উপরোক্ত বাধাগুলোর মধ্যে কিছু সম্পূর্ণরূপে মনুষ্য সৃষ্ট যা শুধু ইচ্ছা ও সংকল্প দ্বারা অপসারণ করা যেতে পারে। অকপট হওয়ার জন্য তারা রাজনৈতিক উপাদানের চেয়ে কর্মকর্তাদের কাছে বেশি আবেদন করে। আশা করছি, এ ব্যাপারে মানসিকতার পরিবর্তন হবে। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনের পরে এটি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। আসলে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে দেশীয় বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। দেশীয় বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় উপস্থিতি দেখে বিদেশিরা এগিয়ে আসবে। তাদের মনে আস্থা জাগ্রত করার জন্য, বাংলাদেশিদের তাদের স্বদেশে বিনিয়োগের উদাহরণ প্রদর্শন করা উচিত এবং এটি ঘটতে সরকারকে সমস্ত বাধা অপসারণ করতে হবে। এটা প্রত্যাশিত যে, বর্তমান রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ব্যবস্থায় প্রভাবশালী খেলোয়াড় হিসেবে আমলাতন্ত্র এর পথ প্রশস্ত করতে এগিয়ে আসবে। অন্যথায়, দৃশ্যকল্পের খুব বেশি উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সূত্র : ডেইলি সান। লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। শশযধংৎঁ@মসধরষ.পড়স।
অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস