তথ্য-প্রযুক্তি, আইসিটি ফিল্যান্সিং এবং স্মার্ট বাংলাদেশ
এনামুল হাফিজ লতিফী ও মো. মমিনুল ইসলাম : ২০২১ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশ দুটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে। প্রথমত, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৪ সালের জানুয়ারির শেষ নাগাদ ২৫.০৯ বিলিয়ন ডলারে (বিপিএম৬ পদ্ধতি : ১৯.৯৪ বিলিয়ন ডলার) নেমে গেছে, যা পূর্বে প্রায় ৪৮.০৬ বিলিয়নের রেকর্ড উ”চ থেকে হ”াস পেয়েছে। এই পতনটি ব্যাপকভাবে মানি লন্ডারিং দ্বারা ব”দ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে গড় মার্কিন ডলার ৮.২৭ বিলিয়ন অবৈধভাবে বার্ষিক ভুল-চালান আমদানি-রপ্তানি পণ্য মূল্যের মাধ্যমে কর ফাঁকি দিতে ও আন্তর্জাতিক সীমানাজুড়ে অবৈধভাবে তহবিল ¯’ানান্তরের মাধ্যমে চুরি করা হয়েছিলো। দ্বিতীয়ত, সামগ্রিক ও খাদ্য মূল্যস্ফীতি উভয় হার বেড়েছে। বাংলাদেশি অর্থনীতির হার যথাক্রমে ৯.৯৩ শতাংশ ও ১২.৫৬ শতাংশের সম্মুখীন হয়েছে (পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট, অক্টোবর ২০২৩)। এই স্পাইকের জন্য দায়ী করা যেতে পারে উ”চতর আমদানি অর্থপ্রদান, গ”হীত আর্থিক নীতির তুলনামূলকভাবে সীমিত কার্যকারিতা ও বিনিময় হারের অ¯ি’রতার কারণকে। বিনিময় হার ২৯.৬৪ শতাংশের তীব্র ব”দ্ধির সাী, ২০২১ সালের আগস্ট টাকা ৮৪.৯৭/ইউএস ডলার থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ১১০.১৫ ইউএস ডলার বেড়েছে। অ-পারফর্মিং লোনের ক্রমাগত সমস্যা অর্থনীতিকে পীড়িত করে চলেছে। বেসরকারি খাতের ঋণ ব”দ্ধিকে উদ্দীপিত করার জন্য সরকারি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, অসাধু খেলাপি ও ব্যবসায়ীরা হুন্ডির মতো অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে ক্রেডিট তহবিল বিদেশে সরিয়ে নি”েছ। এনপিএলকে আরও বাড়িয়ে দি”েছ, অভ্যন্তরীণ বাজারকে আরও চাপ দি”েছ। এইভাবে মুদ্রাস্ফীতির চাপে তারা অবদান রাখছে।
২০৪১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর রপ্তানি আয় ২৫ শতাংশ। বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগের নীট প্রবাহ (এফডিআই) ১০ শতাংশ ও অনাবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স ১৫ শতাংশ ব”দ্ধি করতে পারলে দেশটি এই শক্ত অব¯’ান থেকে বেরিয়ে আসবে। যে কোনো অর্থনীতিবিদ দিতে পারেন এর সহজ সমাধান কিš’ অর্জন করা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। যেহেতু বাংলাদেশের এলডিসি-পরবর্তী যুগে পণ্যদ্রব্য বা পণ্য-খাতের রপ্তানি ব”দ্ধির ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ভর করবে তাই এর মুক্ত বাণিজ্য সম্পর্কিত আলোচনা কতো দ্রুত শুরু করতে হবে। চুক্তি (এফটিএ), আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি (আরটিএ), অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ), চুক্তিগুলো শুরু ও প্রয়োগ করতে হবে। এই ব্যব¯’াগুলোর জন্য বাংলাদেশকে এই চুক্তিগুলির অধীনে তার বাণিজ্য অংশীদারদের শুল্ক ও অন্যান্য সুবিধাগুলো প্রতিদান দিতে হবে। যার মধ্যে বিভিন্ন স্তরে এখনও একটি ভয়-অনুভূতি রয়েছে, একটি উপায়ে কাস্টমস রাজস্ব হ”াস করতে পারে, অন্য উপায়ে, এটি হোম গ্রাউন্ডে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীদের কাছে বেশ কয়েকটি দেশীয় সেক্টরালকে প্রকাশ করতে পারে। অবশেষে ¯’ানীয় সিএমএসএমইগুলোকে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই সমঝোতার আলোচনাগুলো একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে বেশি সময় নেয়। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি এফটিএ নিয়ে আলোচনা করতে গড়ে এক থেকে ১.৫ বছর সময় লাগে কিš’ বাস্তবায়ন পর্যায়ে পৌঁছাতে ৩.৫ বছরেরও বেশি সময় লাগে। বাণিজ্য প্রতিক্রিয়ার সময়কাল বাস্তবায়নের জন্য ১০ বছর পর্যন্ত সময়ও লাগতে পারে। যার অর্থ স্বল্প, দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের অনুমানের অনুমতি দেওয়ার জন্য তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে পর্যবেণ করা ডেটা প্রয়োজন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারেলাইজড স্কিম অফ প্রেফারেন্স প্লাস বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির জন্য পরিবেশ, শ্রম, মানবাধিকার ও শাসন নীতি সম্পর্কিত ৩২টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন মেনে চলতে হবে। দেশগুলো বোঝার জন্য আরও বেশি সময় লাগবে বলে মনে হ”েছ। ইইউএস কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম এর কার্যকরীও দরজায় কড়া নাড়ছে। যা ধাপে ধাপে দেশগুলোর বিস্তৃত পরিসর ও রপ্তানিকারক খাতগুলোকে কভার করবে। দীর্ঘমেয়াদী প্রয়োজনীয়তা ও পণ্য খাতের রপ্তানি ব”দ্ধির আসন্ন অনমনীয় সম্মতির বিষয়ের পরিপ্রেেিত বাংলাদেশ যদি আগামী অর্থবছর থেকে তার রপ্তানি আয় বাড়াতে চায় তাহলে একটি অগ্রগামী দ”ষ্টিভঙ্গি হবে দ”ঢ়তার দিকে মনোনিবেশ করা। পরিষেবা সেক্টরের তাৎণিক উন্নয়ন বিশেষ করে সফটওয়্যার, আইটিইএস রপ্তানি ফ”ন্ট ও আইসিটি ফি”ল্যান্সিং-এ আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। সমস্ত সু-সংযুক্ত নীতিগুলোকে প্রাণবন্ত করে তোলা; যা উৎপাদনশীলতা, উদ্ভাবন ও বিদেশি বাজারের প্রকৃত কারণগুলোর সঙ্গে কাজ করার উপর আরও গুরুত্ব দেয়। ঋণ ২০২২-২৩-এ বাংলাদেশের সফ্টওয়্যার এবং আইটিইএস সেক্টরের সিএজিআর (যৌগিক বার্ষিক ব”দ্ধির হার) ঋণ ২০১৭-১৮ এর তুলনায় ২৫ শতাংশ এ দাঁড়িয়েছে, টেলিকমিউনিকেশন পরিষেবা ও আইসিটি হার্ডওয়্যার রপ্তানি বাদ দিয়ে। আইসিটি সেক্টর ক্রমবর্ধমান হ”েছ কিš’ সাম্প্রতিক অর্থবছর ২০২২-২৩ সালে বাংলাদেশের আইসিটি রপ্তানি আয়ের ৭.৪২ শতাংশের নেতিবাচক প্রব”দ্ধি বোঝায় যে আমাদেরকে আগামী ৫ বছরের মধ্যে আইসিটি আউটসোর্সিং থেকে একটি আইসিটি-পণ্য উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত করতে হবে। প্রব”দ্ধির গতিপথ বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ধাপের কারণে কোভিড-১৯ এর সময় অতিরিক্ত নিয়োগ করা, জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং-এর ক্রমবর্ধমান ব্যবহার সহ, ২০২৪ সালে প্রযুক্তি ছাঁটাই কঠোরভাবে আঘাত করেছে।
অল্প সময়ের জন্য, এই ছাঁটাই প্রযুক্তি আউটসোর্সারদের জন্য সুযোগ তৈরি করবে। কারণ ২০২৭ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক কর্মী ফি”ল্যান্স হবে বলে আশা করা হ”েছ। এদিকে সম্প্রতি পরিচালিত একটি সমীার মার্কিন বাজার থেকে উত্তরদাতাদের ৮১ শতাংশ বলেছেন যে, ফি”ল্যান্সাররা গুরুত্বপূর্ণ তাদের সংগঠন কিš’ মাত্র ৩৮ শতাংশ বলে যে তাদের সং¯’া তাদের পরিচালনায় খুব কার্যকর। এই সুযোগটি দেখে, আউটসোর্সিং পরিষেবা প্রদানকারী আরও সং¯’া, ব্যক্তিগত স্তরে আরও আইটি ইঞ্জিনিয়ার ও আরও বেশি দেশ আইটি হাব হওয়ার চেষ্টা করে একই পাইয়ের বেশি ভাগ দাবি করে আবির্ভূত হবে। তবুও এটা বিশ্বাস করা হয় যে, জেনারেটিভ এআই ও এমএল আরও পরিপক্ক হয়ে উঠলে তারা বিশ্বব্যাপী আউটসোর্স করা দল পরিচালনার জটিলতার কারণে প্রযুক্তি আউটসোর্সিংয়ের ক্রমবর্ধমান চাহিদা প্রতি¯’াপন শুরু করবে।
২০৩০ সালের মধ্যে, ইন্টারনেট অফ থিংস সম্পর্কিত প্রযুক্তি পণ্য ও পরিষেবাগুলো ৫.৫ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার, কাউড কম্পিউটিং ২.১ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ২ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার, ব্লকচেইন টেক ১.২৪ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার, বিগ ডেটা ৫৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছানোর পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। বিলিয়ন, সাইবার সিকিউরিটি ৫৩৮.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আইসিটি পণ্য ও পরিষেবাগুলোকে একত্রিত করার বিপুল বাজার সম্ভাবনা উপলব্ধি করে ভিয়েতনাম প্রযুক্তিগত দিক থেকে একটি শীর্ষ¯’ানীয় দেশ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০২২ সালে, ভিয়েতনামের আইসিটি সেক্টর থেকে রাজস্ব ১৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে আঘাত হানে। যার মধ্যে ১৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হার্ডওয়্যার, ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানি, ¯’ানীয়ভাবে উন্নত সফ্টওয়্যার ও আইসিটি সমাধানের মাধ্যমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, কাউন্টির কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে একটি সার্কুলার (এফই সার্কুলার নং : ০২, তারিখ ৩০ জানুয়ারি ২০২৪) জারি করেছে যাতে সফ্টওয়্যার ও আইটি/আইটিইএস রপ্তানিতে রপ্তানি নগদ প্রণোদনা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ হয়েছে। ফি”ল্যান্সিং ৪ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ হয়েছে। প্রথমত বৈশ্বিক প্রযুক্তির বাজারের পরিবর্তনের কথা বিবেচনা করে যতদূর পর্যন্ত এসসিএম (ভর্তুকি ও কাউন্টারভেইলিং ব্যব¯’া) সম্পর্কিত ডব্লিউটিও চুক্তির বিধানগুলোর বিষয়ে এটা মনে হয় যে এই সিদ্ধান্তটি ¯’ূলভাবে নেওয়া হয়েছিলো। আইসিটি সেক্টরকে নগদ অর্থ ছাড়াই ভ লোভাবে চলতে সম করার ল্েয। প্রণোদনা দেয়া ও এলডিসি-পরবর্তী সময়ে প্রতিযোগিতামূলক থাকে। কিš’, জিএটিটি (সাধারণ চুক্তি, শুল্ক ও বাণিজ্য) এর বিধানগুলোকে মিথ্যাভাবে পড়া, ব্যাখ্যা করা ও জিএটিএস (সেবাগুলোতে বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ চুক্তি) এর সঙ্গে মিল রাখে। এসসিএম চুক্তি শুধুমাত্র পণ্য বাণিজ্যের েেত্র প্রযোজ্য কিš’ এর বিধানগুলো পরিষেবার ভর্তুকিতে প্রযোজ্য নয়।
সরকারি কর্তৃত্ব প্রয়োগে প্রদত্ত পরিষেবাগুলোর তহবিল বা ভর্তুকির জন্য জিএটিএস-এর কোনো প্রভাব নেই। তাই আইসিটি হার্ডওয়্যার রপ্তানি থেকে আইসিটি সফ্টওয়্যার ও আইটিইএস প্লাস আইসিটি ফি”ল্যান্সিংকে ছিন্ন করে সরকারকে কেবল আগের হার পুনঃ¯’াপনের কথা বিবেচনা করা উচিত নয়। বরং সফটওয়্যার, আইটিইএসের জন্য রপ্তানি নগদ প্রণোদনাকে সক্রিয়ভাবে ২০ শতাংশ, আইসিটি ফি”ল্যান্সিং ১০ শতাংশে উন্নীত করা উচিত। কারণ এটি এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরেও ডব্লিউটিও’র কোনো বিধান ও ধারা লড়ঘন করবে না। বাংলাদেশের সফ্টওয়্যার ও আইটিইএস সেক্টর প্লাস আইসিটি ফি”ল্যান্সিং বিবেচনা করে স্বল্প-দীর্ঘ সময়ের বৈশ্বিক বাজারের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য দেশের ডিজিটাল অর্থনীতির আকারকে ৫০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার জন্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং উন্নয়নমূলক উদ্দেশ্যগুলোর অনুসরণে বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের মাধ্যমে আরও ভালো সার্ফিং করা। সরকারের উচিত অবিলম্বে এই বিষয়টির সমাধানের জন্য যোগাযোগ করা। যা প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের, স্বতন্ত্র ফি”ল্যান্সারদের অনুপ্রাণিত করবে। যা রপ্তানি আয়ের ঘরে আনয়ন করে বাজার অনুসন্ধান ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করবে। যা ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে।
লেখক : এনামুল হাফিজ লতিফী একজন বাণিজ্য ও নীতি অর্থনীতিবিদ, যুগ্ম সচিব (রিসার্চ ফেলো), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এবং মো. মমিনুল ইসলাম একজন গবেষণা সহযোগী, বেসিস। সূত্র : ডেইলি সান। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস