সততা, সাহস আর পরিশ্রমের মানসিকতা থাকলে কেউ-ই জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে থাকবে না
হাসান মোহাম্মদ মাহাদী : একজনের ফেসবুক পোস্টে দেখলামÑআদ্রিতা নামের ব্র?্যাক ইউনিভার্সিটির সিক্সথ সেমিস্টারের এক ছাত্রী পড়াশোনার পাশাপাশি লাঞ্চ বিক্রি করছে। ব্র্যাকের পাশেই খাবার বিক্রি করছে তার বন্ধুবান্ধব, সিনিয়র ও জুনিয়রদের কাছে। বেশ সাহসী ও স্মার্ট উদ্যোগ এটি। এই নিউজ দেখে আমার কয়েকজন শিক্ষার্থীর কথা মনে পড়লো যাদের সবাই বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে বা পড়াশোনা শেষ করেছে।
একজন তার অনার্স ও মাস্টার্সের টিউশন ফি’র প্রায় ১১ লাখ টাকা শুধু টিউশন করেই দিয়েছে। পাশাপাশি প্রায় ছয় বছর নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ নিজেই জুগিয়েছে। এখন সেকেন্ড মাস্টার্স করছে আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আরেকজনের বাবা রিক্সা চালক। ও উত্তরবঙ্গ থেকে এসে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলো। দিনের বেলা ক্লাস ও পড়াশোনা করতো এবং রাতে ফুলটাইম কাজ করতো এক প্যাকেজিং কোম্পানিতে। আঞ্চলিক উচ্চারণের কারণে টিউশনি পেলেও টিকেনি বেশিদিন। প্যাকেজিং কোম্পানির অফিসেই ও প্রায় তিনবছর থেকেছে কয়টা টাকা বাঁচানোর জন্য। এখন স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স করছে নরওয়েতে।
আমি ফাইটার নামে ডাকতাম আরেকজনকে। একসাথে ৫/৬টা টিউশনি করে নিজের টিউশন ফি’র সব টাকা দিতো। তার মেয়ের স্কুলের বেতন পরিশোধ করতো। সকালে বের হয়ে ক্লাস শেষে পাঁচ-ছয়টা টিউশনি করে রাতের ১০/১১টা বাজে বাসায় ফিরতে হতো। এভাবে একটানা প্রায় পাঁচবছর খেটে এখন দেশেই একটা ফুলটাইম জব করছে। আরেকজনকে চিনি, যে কড়াইল বস্তির পাশে থাকতো। মাত্র ২০০/৩০০ টাকায় বস্তির নিম্নআয়ের মানুষের বাচ্চা পড়াতো। একদম ফ্রেন্ডলেস ছিলো ক্যাম্পাসে। আগ্রহ নিয়ে একদিন তার সাথে কড়াই বস্তি যেয়ে দেখি- সব বাচ্চারা স্যার বলে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ও নিজ বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট হয়েছিলো। এখন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার। ফান্ড পেলেই বিদেশে যাবে পিএইচডি করতে। আমার আরেকজন ছাত্রকে দেখতাম, প্রতিদিন একই শার্ট পড়ে আসতে। প্রেজেন্টেশনে ড্রেসকোড থাকার পরেও একই জামা তার গায়ে। মাঝেমধ্যে আরেকটা টিশার্ট পড়তো। এভাবেই দেখেছি তিনটা সেমিস্টার। কলসেন্টারে কাজ করতো সারারাত। ঘণ্টা ৬০/৭০ টাকা। ক্লান্ত শরীরে সকালে ক্লাসে আসতো লাল চোখ নিয়ে। এভাবেই অনার্স শেষ করে এখন একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করছে।
আরেক মেয়ে তার প্রেগন্যান্সির একদম ক্রিটিক্যাল টাইমে এসে সেমিস্টার ফাইনাল দিয়েছিলো। অথচ এর মাত্র দুইদিন পর তার ইডিডি ছিলো। পরীক্ষা শেষে বললো, সেমিস্টার ড্রপ দিলে তার স্কলারশিপ ছুটে যাবে। তখন টিউশন ফি কেউ দেবে না। না হাজব্যান্ড, না তার বাবা-মা। জানি না পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছিলো কিনা। দোয়া করি ও ভালো থাকুক। শুধু এই ক’জন না, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি এমন অনেক সংগ্রামী শিক্ষার্থী পেয়েছি। তাদের জীবনের গল্প আমাকে বিমোহিত করেছে। নতুন করে ভাবতে সাহায্য করেছে। আমার শিক্ষকতার ভাবনাকে নতুন করে সাজাতে সাহায্য করেছে এসব যোদ্ধারা। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মানেই বাপের টাকায় পড়াশোনা-এটা অনেকের ক্ষেত্রেই সত্য না।
এমন অসংখ্য শিক্ষার্থী আছে যাদের কোনো শুক্র-শনিবার নেই। আর আমার অবজারভেশন বলে, জীবনযুদ্ধে এরা এগিয়ে যায়। নিজের পায়ে দাঁড়ায়। লোকে কী ভাবলো বা পেছনে বললো, এসবের তোয়াক্কা এসব শিক্ষার্থীরা করে না। আদ্রিতার মতো এরা নিজ উদ্যোগে এগিয়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি, সততা, সাহস আর পরিশ্রমের মানসিকতা থাকলে কেউ-ই জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে থাকবে না। রিজিক এর পেছনে আপনাকে দৌড়াতে হবে না। রিজিক-ই আপনার কাছে দৌড়ে আসবে, ইনশাআল্লাহ। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ধরনের শিক্ষার্থীদের নিয়ে লিখবো আরেকদিন…। ফেসবুকে ১২-২-২৪ প্রকাশিত হয়েছে।