বাংলাদেশ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলেও অন্যরা কীভাবে সফল হয়েছে?
অনুপম দেবাশীষ রায় : আমরা তাই যা আমরা খাই। তাই সেই যুক্তি অনুসরণ করে যারা যাত্রাবাড়ীর বাজার থেকে পাঙ্গাস মাছের হাড় কিনে খাচ্ছেন, সাম্প্রতিক একটি নিউজ ফিচারে দেখা গেছে, তারা মাছের হাড়ের মতো। আমি এখানে যে রূপক মাছের ইঙ্গিত করার চেষ্টা করছি তাহলো বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং যাদের উচ্চবিত্তের আবর্জনা খেতে হয় তাদের কঙ্কাল। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি তার কঙ্কালের যত্ন নেওয়ার জন্য খুব কমই করছে বলে মনে হচ্ছে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ অসাধারণ অর্থনৈতিক প্রসার দেখেছে। জিডিপি অসাধারণ গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর বৃদ্ধির সঙ্গে মূলধন আরও শক্তিশালী হয়েছে। জিডিপি বৃদ্ধির ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়নি। কারণ অনেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে যাওয়া থেকে এক ধাক্কা দূরে। আমাদের অর্থনীতির বৃদ্ধি স্থূলভাবে অসম হয়েছে। মিলিয়নিয়ারের সংখ্যা আকাশচুম্বী ও নিম্ন শ্রেণি একই সময়ে শেষ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর উচ্চতা হলো শ্রমিক শ্রেণির প্রতিদিনের খাবারের সামর্থ্যরে অক্ষমতা। মূল্যবৃদ্ধি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে সাধারণ মানুষ ডিম, মৌসুমী সবজি, চাল, মসুর ডালের মতো মৌলিক পণ্যও কিনতে পারছে না। মাংস বা মাছ কেনা তো দূরের কথা। এ কারণেই এই ‘অস্বীকারের বাজারে’ আরও লোক ভিড় করছে। যেখানে আপনি মাছের হাড় বা মুরগির পা কিনতে পারেন, যা উচ্চবিত্তরা খেতে সাহস করে না।
কেন বাংলাদেশ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলেও অন্যরা সফল হয়েছে : নিওলিবারেল ইকোনমিক্সের ট্রিকল-ডাউন ধারণার ব্যর্থতার এটাই ক্লাসিক ঘটনা। ধারণাটি এভাবে চলে: যদি একটি দেশে পুঁজি বৃদ্ধি পায় তবে এটি অবশ্যই সমগ্র অর্থনীতির জন্য উপকৃত হবে। তখন আরও বেশি সম্পদ তৈরি হবে। কারণ ক্রমাগত ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ কর্মসংস্থানের সুযোগ ও নিম্নতর জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করবে। তবে বাংলাদেশের জন্য তা সত্য নয়। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া পুঁজি এখানে অন্তত সামান্য সংখ্যালঘু জনগণ পৃষ্ঠপোষকতা ও দুর্নীতির মাধ্যমে বরাদ্দ করেছে। শ্রমিক শ্রেণি সীমিত বেতনের চাকরিতে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। যা মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয় না। ফলে, শ্রমিক শ্রেণীর উপার্জন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মূল্য হারাতে থাকে। এই লোকেরা যা সঞ্চয় করতে পারে তা প্রতি বছর সঙ্কুচিত হতে থাকে। এই সময়ে মাছের হাটে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। গ্রাসকারী পুঁজিবাদের স্থূল বডিজ বর্জ্যরে ভোক্তাদের শ্রমের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে ও বৃদ্ধি পায়। আর মাছের আবর্জনার মতো শ্রমিক শ্রেণীও পুঁজিবাদী অর্থনীতির অবাঞ্ছিত। কর্মীকে সম্পূর্ণরূপে ছত্রভঙ্গ হিসাবে দেখা হয়। গার্মেন্টস শিল্পে তাদের কাজগুলো তাদের ক্যারিয়ার বৃদ্ধির বিকল্প দেয় না, তবে যতোক্ষণ প্রয়োজন ততোক্ষণ তাদের একটি অদক্ষ অবস্থানে আটকে রাখে। যখন তারা বিদ্রোহ করে ও উচ্চ মজুরির দাবি করে তখন রাষ্ট্র পুঁজির ক্ষমতার সালিশকারী হিসাবে আসে। যা রাজধানীর পক্ষে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। যাত্রাবাড়ী হাটে শ্রমিকের দাম প্রতি পিস মাছের হাড়ের চেয়েও কম ২০-৩০ টাকা। কোটিপতি পুঁজিপতির লেন্স থেকে দেখা যায় যে বেকারদের রিজার্ভ আর্মি থেকে খুব সহজেই আরেকজন অদক্ষ শ্রমিক কিনতে পারে।
কেন কম বৈশ্বিক মূল্য বাংলাদেশি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছায় না? মধ্যবিত্ত একদিন বুর্জোয়াদের মতো হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে। তাদের তুচ্ছ স্বপ্নকে দীর্ঘায়িত করতে ঘুমের মধ্যে ডুবে আছে। কিন্তু দেশে সংস্কার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ যে অর্থনীতি তার শ্রমিক শ্রেণির যত্ন নেয় না তাকে কখনোই প্রগতিশীল অর্থনীতি হিসেবে গণ্য করা যায় না। আমরা সংবাদে যে সমস্ত অগ্রগতির কথা শুনি তা আজ শূন্য হয়ে যায় ও প্রশ্ন জাগে: অগ্রগতি কার জন্য? সরকারের সাড়া কোথায়? লাখ লাখ মানুষের জীবন জড়িত এই উদ্বেগগুলোকে মোকাবেলা করার পরিবর্তে সরকার কেবলমাত্র যারা সংকটে রয়েছে তাদের ক্ষতি করার জন্য আরও বেশি কাজ করছে। কোটিপতিদের বেইল আউট করা, টাকা ছাপানো, ঋণ মওকুফ করা শুধুমাত্র টাকার মূল্য হ্রাস করবে ও অর্থনৈতিক সংকটকে আরও খারাপ করবে। আমরা কেবল রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আশ্বস্ত করার কথা শুনি কিন্তু পণ্যের ক্রমাগত ক্রমবর্ধমান মূল্যের উপর স্থায়ীভাবে লাগাম লাগাতে কোনো যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। টিসিবি ট্রাক যেগুলো কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করে সেগুলো হলো স্টপগ্যাপ সমাধান। আমাদের যথাযথ অর্থনৈতিক সমাধান বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে শ্রমিক শ্রেণির যত্ন নেওয়া হয়। নোবডজকে তাদের মাসিক বাজেটের জন্য মাছের মাংসের পরিবর্তে মাছের হাড় খাওয়ার অবলম্বন করতে হয় তা নিশ্চিত করার জন্য কল্যাণ ও সামাজিক সুরক্ষা জালের বিধান অন্তর্ভুক্ত।
‘আমি উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য অপশাসন ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করি’। এই কাজের জন্য কেবল শব্দই যথেষ্ট নয় পদক্ষেপও প্রয়োজন। সুসংগঠিত গণআন্দোলন সময়ের দাবি রাখে। কিন্তু এমন আন্দোলনের আয়োজন করবে কে? কার সাহস বা স্বার্থ আছে? বাম দলগুলোর ভূমিকা এখানে অপরিহার্য হতে পারে কিন্তু এমনকি তারা তাদের নিজস্ব বাগ্মিতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বের বাইরে আর বেশি যত্নশীল বলে মনে হয় না। কিন্তু যদিও দলগুলো ব্যর্থ হয় এবং কোনো উপায় ছাড়াই মানুষ রেখে গেলেও তারা নিজেদের স্বার্থে নিজেদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। যেমনটা ইতিহাস আগেও বহুবার দেখিয়েছে। মাছের হাড়ের পুরো মাছের মধ্যে তার অবস্থান পুনরুদ্ধার করার সময় এসেছে। এখানে সেই সুন্দর দিনটির আগমন কামনা করা হচ্ছে। সূত্র : ডেইলি স্টার। লেখক : স্কুল অফ ইকোনোমিক্সের (এলএসই), লন্ডন, ইংল্যান্ড। স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস