বিশ্বে দুর্নীতি একটি মহামারি ও আমাদের সমাজ
হুসাইন ইমাম : একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের সমাজে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। এটি এতোই ব্যাপক ও গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে যে কেবলমাত্র কিছু ব্যক্তি বা সংস্থা রয়েছে যাদের দুর্নীতি এক বা অন্যভাবে স্পর্শ করেনি। দুর্নীতি আমাদের সমাজে এতো গভীরভাবে গেঁথে গেছে যে আমরা এটি ছাড়া একটি জীবন প্রায় ভুলে গেছি। দুর্নীতি একটি প্রাণঘাতী ভাইরাস। যা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বছরের পর বছর যাবৎ হৈ-হুল্লোড়ের পরও আমরা কোথাও এর থেকে কোনো অবকাশ পাই না। খাদ্য, ওষুধ, জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, আমলাতন্ত্র, পুলিশ, কাস্টম, রাজস্ব, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মিডিয়া, বিচার বিভাগ, যেকোনো সেক্টরের নাম আমরা প্রায় সর্বত্রই এর উপস্থিতি দেখতে পাই। কেন আমরা শুনি যে একজন প্রার্থী এমপিও-তালিকাভুক্ত বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকের চাকরির জন্য ঘুষ হিসেবে ৫ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে? এমনকি জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মূল্যবোধের ঘাঁটি বলে মনে করা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ অপকর্ম থেকে মুক্ত নয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও রাজনৈতিক প্রভাবের কথা আমরা প্রায়ই শুনি। কেন আমরা শুনি পানামা, প্যারাডাইস ও প্যান্ডোরা পেপারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শতশত শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, সেলিব্রেটি ও মাফিয়া প্রভুর নাম অন্যায় উপায়ে মিলিয়ন ডলার সিফোন করে ও বিনিয়োগ করে? তথাকথিত অফশোর কোম্পানিগুলো কি আর্থিক কেলেঙ্কারি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ওয়াচডগের নামে এতো সরকারি যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও কর ফাঁকি দিচ্ছে?
আমাদের সরকারি অফিসে ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না কেন? তারা একে গতির অর্থ বলে। কী শৈল্পিক নাম। গতি টাকা। ধর্মের যন্ত্র হাওয়ায় চলতে পারে (ধর্মের কাল বাতাশে নোরে), কিন্তু সরকারি যন্ত্র তা করে না। শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় সংবাদপত্র ‘ইন্ডিয়ার এক্সপ্রেস’ দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে, কয়েক বছর আগে ‘পেনডোরা পেপারস’ ফাঁস হওয়া তথ্যের তদন্তে ৩০০টিরও বেশি ভারতীয় ব্যবসায়িক টাইকুন, কর্পোরেট সংস্থা, সেলিব্রিটি, রাজনীতিবিদ এবং সমাজের অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে। ট্যাক্স হেভেনের তালিকায় বাংলাদেশি টাইকুনদের নাম উল্লেখ না করার জন্য তারা যথেষ্ট বিনয়ী ছিলো। সংখ্যাটা ৩০০ না হলে ৩০-এর কম হতে পারে। দেশের অর্থনীতির আকার বিবেচনায় অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচারের দৌঁড়ে বাংলাদেশ খুব একটা পিছিয়ে নেই। হ্যাঁ, আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সরকারের জিরো-টলারেন্স নীতির কথা প্রায়ই শুনি না। পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা কঠোর পদক্ষেপের কথা শুনি। কিন্তু বাস্তবে আমরা কতোদূর এগিয়েছি? সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযান শুরু হয় ঝাঁকুনি দিয়ে ও শেষ হয় হুঙ্কার দিয়ে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। ফলে পৃথিবীর এই প্রান্তে আজ তার মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা প্রতিটি শিশুকে একটি বিশাল ঋণ সেবার খেসারত বহন করতে হবে।
দুর্নীতি বহুমাত্রিক। দরিদ্র বলেই একদল মানুষ দুর্নীতিবাজ। তারা যে সামান্য আয় করে তা দিয়ে তারা তাদের বাচ্চাদের জন্য দুধ বা তাদের সন্তানদের শিক্ষার খরচ বহন করতে পারে না। সুতরাং তারা অর্থ উপার্জন এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ঘুষ নেওয়া বা অবৈধ উপায়ে লিপ্ত হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ খুঁজে পায় না। অন্য একটি গোষ্ঠী ধনী কিন্তু তাদের প্রতিবেশীদের মতো ধনী নয়, যদিও তারা নিজেদের প্রতিবেশীদের চেয়ে বেশি যোগ্য এবং দক্ষ বলে মনে করে। তাদের প্রতিবেশীরা যারা দামি গাড়ি চালায় তারা আভিজাত্যের বাড়িতে থাকে। এমনকি একটি থ্রি-হুইলার বা টু-বেডের ফ্ল্যাটও তাদের সামর্থ্য নয়। প্রতিবেশীর স্ত্রীরা দামি পোশাক পরে। প্রতিবেশীরা ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর বা সুইজারল্যান্ডে ছুটি কাটায়। অন্যদের কুয়াকাটা ভ্রমণের সামর্থ্যও নেই। তাই তারা অবৈধ উপায় অবলম্বন করে ও একটি অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় নামে। আর একদল মানুষ যেকোনো উপায়ে ধনী ও ধনী হওয়ার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেয় ও তাও রাতারাতি। তারা যেকোনো মাত্রায় যেতে প্রস্তুত দখল, প্রতারণা, এমনকি যে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করতে। তারা যতো বেশি পায়, ততো বেশি চায়। তারা জীবনে বিলাসিতা, বিলাসিতা ও কল্পনা চায়। ফলাফল অপরাধ, সহিংসতা, যৌন নির্যাতন, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক। কীভাবে আমরা দুর্নীতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া ঘোড়ার গলায় লাগাম বেঁধে তার উন্মত্ত দৌঁড় থামাবো? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের অর্থনীতি দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। এক দশকেরও কম সময়ে দেশটির মাথাপিছু আয় ৫০০ থেকে বেড়ে ৩,০০০ টাকা হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ৬.৫ শতাংশের কাছাকাছি চলে আসছে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য প্রস্তুত।
তবুও অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য দুর্নীতি একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হতে পারে। এটা সমাজের অত্যাবশ্যকীয় জিনিস খেয়ে ফেলতে পারে। দেশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। দুর্নীতি লোভ ও লালসা জন্ম দেয়। এই উপাদানগুলো সমস্ত মৌলিক মানবিক মূল্যবোধকে বাতিল করে ও মানুষকে বর্বর করে তোলে। প্রতিদিন আমরা ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আর্থিক কেলেঙ্কারি, লুণ্ঠন, সহিংসতা, হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনার কথা শুনি। এর সবই লোভ ও বর্বর লালসা মেটানোর জন্য। কোভিড মহামারী, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বা প্রায় সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পিছিয়ে দিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্বের হারের তীব্র বৃদ্ধি এবং চির-হুমকিপূর্ণ খাদ্য ও জ্বালানি সংকট সমাজের কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলছে। এই সংকটময় সন্ধিক্ষণে দেশ পরিচালনার পুরো দিকটি উদ্ধার করার সময় এসেছে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে দুর্নীতির এই মারণ ভাইরাস থেকে মুক্ত রাখতে সমাজের প্রতিটি স্তরের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা উচিত। লাগামহীন দুর্নীতির কলঙ্কের অবসান ঘটানোর একটি উপায় থাকতে হবে যা আমাদের অর্থনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশকে খেয়ে ফেলছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারকে লৌহ হাতে মোকাবেলা করতে হবে। জনগণ, রাজনীতিবিদ বা সরকারের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য শুনতে চায় না। তারা ব্যবসা চায়।
সূত্র : নিউ এইজ। লেখক : একজন অবসরপ্রাপ্ত বণিক মেরিনার এবং কলামিস্ট। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস