কল্লোল মোস্তাফা
ওয়াসার সরবরাহ করা পানির উৎস, পরিমাণ ও গুণগত মান নিয়ে অভিযোগের মধ্যেই ওয়াসা বছর বছর পানির দাম বাড়িয়ে চলেছে। ঢাকা ওয়াসা গত ১৪ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে। আবারও পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তুলেছে সংস্থাটি।
গত মাসে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ওয়াসার প্রস্তাবে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা, মধ্যবিত্তদের জন্য ২৫ টাকা, উচ্চমধ্যবিত্তদের জন্য ৩১ টাকা ২৫ পয়সা এবং উচ্চবিত্তদের জন্য ৩৭ টাকা ৫০ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০০০ অনুসারে ফ্ল্যাটের আয়তনভেদে গ্রাহকদের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিতে বিভক্ত করা হবে।
আপাতদৃষ্টে আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় পানির দাম নির্ধারণের বিষয়টি ভালো মনে হলেও এর বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও ফলাফল নিয়ে বেশ কিছু আশঙ্কা রয়ে যায়।
প্রথমত, এই প্রস্তাব অনুসারে যে শুধু উচ্চবিত্তদের পানির দাম বাড়বে তা নয়, মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নমধ্যবিত্ত সবারই পানির দাম বাড়বে। এ প্রস্তাব অনুমোদিত হলে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির জন্য উচ্চবিত্তদের বর্তমান দামের চেয়ে ২২ টাকা ৩২ পয়সা, উচ্চমধ্যবিত্তদের ১৬ টাকা ৭ পয়সা, মধ্যবিত্তদের ৯ টাকা ৮২ পয়সা ও নিম্নমধ্যবিত্তদের ৩ টাকা ৫৭ পয়সা বেশি দামে পানি কিনতে হবে। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার পানি ব্যবহারকারীদের মধ্যে সাড়ে ৮৩ শতাংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত হওয়ার কারণে নতুন প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে এই দুই শ্রেণির মানুষকেই বেশি দাম দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ফ্ল্যাটের আকার-আকৃতিভেদে বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকদের কীভাবে শনাক্ত করা হবে, তা স্পষ্ট নয়। ঢাকা শহরের সব ফ্ল্যাটের আকার-আকৃতির নির্ভুল ডেটাবেজ কি কারও কাছে আছে? একশ্রেণির গ্রাহকদের যে অন্য শ্রেণির গ্রাহক হিসেবে ধরে নিয়ে বেশি বিলের বোঝা চাপানো হবে না তারই-বা নিশ্চয়তা কী?
তৃতীয়ত, বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দাম নির্ধারণ করা হলে শ্রেণিভেদে পানির প্রাপ্যতা ও মানে তারতম্য হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানেও দেখা যায়, নগর ও শহরের যেসব এলাকায় ধনী মানুষদের বসবাস সেখানে সরবরাহ করা পানির মান তুলনামূলক ভালো এবং পানির প্রাপ্যতাও বেশি। নিম্নবিত্ত-অধ্যুষিত এলাকায় শুকনো মৌসুমে প্রায়ই পানি পাওয়া যায় না, যাও পাওয়া যায়, তা থাকে ময়লা, দুর্গন্ধযুক্ত ও জীবাণু-আক্রান্ত।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ওয়াটার গভর্ন্যান্স ইন ঢাকা শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকায় দৈনিক মাথাপিছু পানির ব্যবহার গড়ে ৩৬০ লিটার। এর মধ্যে গুলশান ও বনানী এলাকায় মাথাপিছু পানির ব্যবহার ৫০৯ লিটার, বাড্ডা, কুড়িল ও জোয়ার সাহারা এলাকায় ২১৫ লিটার, আর বস্তি এলাকায় মাত্র ৮৫ লিটার। এখন ধনীদের কাছে পানি বিক্রি করে বেশি অর্থ পাওয়া গেলে, শুকনো মৌসুমে পানির সংকটের সময় দরিদ্রদের বঞ্চিত করে ধনীদের যে বেশি পানি সরবরাহ করা হবে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে? (লেখক: সর্বজন কথার নির্বাহী সম্পাদক)