দেশের মূল্যস্ফীতি কেন কমানো যাচ্ছে না, অর্থনীতির চাপ কোথায়?
করেনাা মহমারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। বিশ্ব অর্থনীতি বেশ চাপে পড়েছে। বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির দেশও বড় ধরনের সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশও আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি গত এক যুগ ধরে ভালোভাবে এগোলেও সাম্প্রতিকালে বেশ চাপে পড়েছে। মূলস্ফীতি, ডলার সংকট, মুদ্রা পাচার,
ব্যাংক খাতের অনিয়মÑসবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। সরকারও অর্থনীতিকে ভালো করার উপায় খুঁজছে। মূলস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ারও চেষ্টা করছে। আমাদের অর্থনীতির সংকটটি আসলে কোথায়? কীভাবে অর্থনৈতিক সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে সরকার? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা? এ নিয়ে তারা কথা বলেছেন আরটিরি ‘বিজনেস টক’-এ। ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস
[১] ড. আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট: বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার সবাই একটি জিনিস স্বীকার করেছেন যে, মূল্যস্ফীতি হচ্ছে আমাদের একটি বড় সমস্যা। এই মূল্যস্ফীতির সাথেই আমাদের অনেককিছু জড়িত। সেই মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য গত কয়েকমাস ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংক ছোট ছোট পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা বিভিন্ন রকম নয়-ছয় থেকে বের হয়ে এসেছে। কিন্তু পুরোপুরি পরিত্যাগ করেনি। এবার আমরা আশা করেছিলাম যে সরকার আরেকটু শক্তভাবে বড় আকারের পদক্ষেপ নিতে পারবে। কিন্তু আমার কাছে তা মনে হয়নি। যে সিগন্যাল দেওয়া হয়েছে তা যুক্তিসঙ্গত। যতদিন পর্যন্ত না মূল্যস্ফীতি কমে আসে ততদিন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি থাকবে। কিন্তু যেটি আমরা আশা করেছিলাম যে যতদিন পর্যন্ত আমাদের মূল্যস্ফীতি কমে না আসে ততদিন পর্যন্ত ইন্টারেস্ট রেট বাড়াবো। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে জুন মাসের শেষে ৭.৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে আসা ও বছরের শেষ নাগাদ ৬ শতাংশে নিয়ে আসা।
ভারত যদি ৩-৪ শতাংশ রাখতে পারে বা অন্যান্য উন্নত দেশ যদি ২ শতাংশ রাখতে পারে তাহলে আমাদের কেন ৬ বা ৭ শতাংশর কথা বলা হয়? আমরা কেন এটিকে কমিয়ে এনে আমাদের সাধারণ মানুষের জীবনকে একটু স্বচ্ছল করতে পারি না? আমাদের ওভারঅল স্থিতিশীলতা আনতে হলে মূল্যস্ফীতি আরো কমাতে হবে। সেজন্য আমি মনে করি এটি ৬ না হয়ে আমাদের ৪ শতাংশ টার্গেট হওয়া উচিত। গত জুন থেকে যদি কয়েকবার সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু আমি বলবো পর্যাপ্ত বাড়ানো হয়নি। তারা .২৫ শতাংশ করে ৮ বারে ২ শতাংশ বাড়িয়েছে মাত্র। আমাদের খেয়াল করতে হবে ইন্টারেস্ট রেট কতগুলো মাল্টিপল পজেটিভ ইমপেক্ট আনে। যদি পর্যাপ্ত সরবরাহ বাজারে না বাড়ানো যায় তাহলে মূল্যস্ফীতি কখনোই কমবে না।
ইন্টারেস্ট রেট বাড়ালে আমরা ২-৩ টি অবজেক্টিভ এচিভ করতে পারব। আমরা দেখেছি পৃথিবীর সবগুলো দেশেই মূল্যস্ফীতি কমে আসছে আস্তে আস্তে। কিন্তু আমরা কেন পারছি না? কারণ অন্য দেশগুলো সমস্যাটিকে চিহ্নিত করেছে, যেটি আমরা করছি না। সেই জায়গাটিতেই আমাদের সাথে অন্যান্য দেশগুলোর পার্থক্য। পৃথিবীতে অনেক ধরনের সিস্টেম আছে। ক্রলিং প্যাক খুব একটি পপুলার সিস্টেম নয়। কিছু ছোট ছোট দেশ এটি নিয়ে কাজ করছে। আমি জানি না আমরা কেন এটি নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব সিস্টেমই ভালো যদি এটিকে ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়। আমারা কি আসলে সেভাবে চালাবো? যখন আমরা একটি নীতি গ্রহণ করবো তার দুইমাস পরেই যদি আমরা সে নীতি যদি বাস্তবায়ন না করি, তাহলে কি সেই নীতি থেকে কোনো রেজাল্ট পাওয়া যাবে? আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা নীতিগুলো গ্রহণ করি, কিন্তু ঠিকমত প্রয়োগ করতে পারি না। যার জন্য আমরা এসব নীতি থেকে কোনো ফল লাভ করতে পারি না।
[২] অধ্যাপক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী, সাবেক মহাপরিচালক, বিআইবিএম: নতুন মুদ্রানীতির প্রধান উদ্দেশ্য হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। আমি মনে করি না যে এই মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি শুধু ইন্টারেস্ট রেটের উপর ডিপেন্ড করে না। এখানে সাপ্লাই চেইন স্মুথলি করতে হবে। আমি মনে করি যে মুদ্রাস্ফীতির পেছনে একটি অন্যতম কারণ হলো ব্যবসায়িক সম্প্রদায় কোনোভাবেই কন্ট্রোলে আসছে না। উনাদের যে স্বেচ্ছাচারিতা সেটি কন্ট্রোল করার মতো সরকারি কোনো পদক্ষেপ নেই, যা মূল্যস্ফীতিকে যথেষ্টভাবে ইফেক্ট করে। ব্যাংকিংয়ের সাধারণ সমস্যাগুলোও সমাধান করার মতো কোনো বিষয় আমারা মুদ্রানীতিতে দেখতে পাইনি। আমার মূল বক্তব্য হচ্ছে এটি মোটামুটিভাবে একটি দায়সারাগোছের মুদ্রানীতি। কারণ আমাদের মূল্যস্ফীতি এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, যদি আমরা ভালোভাবে চতুর্মুখী অ্যাকশন না নিই তাহলে কিছুই হবে না। এই মুদ্রানীতিতে ল্যান্ডিং ভলিউম কমানোর আশা করা যায় না।
বর্তমান বাজারে প্রচুর মজুদ থাকা সত্ত্বেও চালের দাম বাড়তি। এটি অবশ্যই ইন্টারেস্টের জন্য হচ্ছে না। মনিটরিং ঘাটতির জন্য আজ এই অবস্থা। যে যার খুশিমতো দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই ক্ষেত্রগুলোতে যদি আমরা ঠিকঠাকভাবে কাজ না করি তাহলে ইন্টারেস্ট রেট বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর কোন চিন্তাই করা যায় না। ব্যাংকিং খাত তারল্য সংকটে ভুগছে, এর জন্য আমি ব্যাংকিং খাতকেই দায়ী করবো। তারা তাদের ডিপোজিট ল্যান্ডিংয়ে সমতা রাখতে পারে না। মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে হয়তো শুধু ল্যান্ডিং রেট বাড়ানো গেলো। কিন্তু এটি দিয়ে আমাদের পুরোপুরি তারল্য সংকট মেকাবেলা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তার কজকর্ম নিজে নিজে করতে পারার মতো সক্ষমতা থাকলে মুদ্রনীতির কার্যকারিতা আস্তে আস্তে আমাদের চোখেপড়া শুরু হবে।
[৩] ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড: আমরা গত দুইবছর যাবৎ বলে আসছি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা। কিন্তু এটি কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। এটির সাথে সাধারণত অনেক ব্যাপার জড়িত। অন্যান্য বিষয়গুলোর ব্যাপারে কাজ না করে যদি শুধু মূল্যস্ফীতি কমাতে চাওয়া হয় এবং সেজন্য শুধু সুধের হার বিবেচনা করলেই এটির কোনো সমাধান আসবে না। যদি সুদের হার বাড়ানো হয় তাহলে বড়দেরই আরো লাভের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এসএমই বা অন্যদের আরো দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ এই এসএমই-রাই পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ইত্যাদি বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে বেশি ভূমিকা পালন করে। শুধু সুদের হার বাড়িয়ে আমি অর্থনীতিকে একটি সমন্বিত অবস্থায় আনবো, এটি মনে করা একদমই যুক্তিযুক্ত নয়।
এসএমই এবং বড়দের মধ্যে আলাদা ভাগ করে দেওয়া যেতে পারে। যাতে করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয় বাড়ে। করোনার সময় ৭০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হলো। ৩০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হলো বড়দের। বড়রা সেই টাকা নিয়ে কোথায় কী করেছে না করেছে তার কোনো তথ্য নেই। এসএমই-দের বলা হলো তারা যেন ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে নেয়। কিন্তু ব্যংক তাদের কেন দিতে যাবে? যারা বড় ব্যাংক শুধু তাদেরই দেয়। এতে করে এসএমই আরো নিচের দিকে চলে গেছে। সুতরাং এক্ষেত্রে দুজনের বেলায় দুই ধরনের নিয়ম করা যেতে পারে। প্রত্যাশা যা করা হয়েছে তার সাথে বাস্তবতার মিল খুব একটি হয়নি। প্রচেষ্টা ছিলো কিন্তু সফলতা খুব একটি হয়নি।
আমরা ঘুরেফিরে কিন্তু ব্যাংকিং সেক্টরে আসছি এ জন্যেই যে মূল্যস্ফীতির সাথে বা ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে ব্যাংকিং সেক্টরের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গাগুলোতে আমাদের দেখতে হবে যে সকল ব্যপারে আমরা সুশাসনের দিকে যাচ্ছি কি না। একটি কড়া মেসেজ যদি না দেওয়া যায়, তাহলে সামাল দেওয়া খুব কঠিন হয়ে যাবে। অর্থনীতির সমস্যাগুলোকে পুরোপুরিভাবে বের করে এনে ঠিকঠাক পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনীতিতে সুস্থতা ফিরে আসার একটি বড় শর্ত হচ্ছে সকলের আস্থা। সেটি থেকেই মানুষ স্বীকার করে নিবে যে আস্তে আস্তে সব ঠিক হওয়ার দিকে যাচ্ছে। রাজশাহীতে যে আলু বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকা কেজি সেই আলু ঢাকায় ৩৫ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে কেন? সবক্ষেত্রে নজর দিতে হবে। মাননীয় খাদ্যমন্ত্রী অনেক কিছুই করবেন বলেন, কিন্তু এখনো তা খুব বেশি একটা দৃশ্যমান হয়নি। আমি মনে করি এখন সবাইকে নিজের দিকে তাকাতে হবে। নিজেরা নিজেদের সমস্যা বুঝে সেটিকে কীভাবে কাটিয়ে উঠা যায় সেই পথ খুঁজে বের করতে হবে। সকলের আস্থা অর্জন করতে হবে স্বচ্ছতার সাথে।