আমেরিকান ফুটবল, আমেরিকান ফুটবলের নিয়ম ও উত্তাপ-উত্তেজনা
রাগিব হাসান : আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হলো আমেরিকান ফুটবল। দেশটির সবচেয়ে বড় লিগ এনএফলি-এর চ্যাম্পিয়নশিপ গেইম, যার নাম সুপারবৌল। পুরো আমেরিকায় এটা নিয়ে রীতিমতো উৎসব উৎসব ভাব। বিশেষ করে ফুটবল পাগল দক্ষিণের দিকের রাজ্যগুলোতে এই সময়টাতে কী যে উন্মাদনা চলে তা বলার বাইরে। এবারের সুপারবৌলের অন্য মাত্রা হলো সুইফটিরা। তাদের প্রিয় তারকা টেইলর সুইফটের প্রেমিক ট্রাভিস কেলসি খেলবে ফাইনালে। তাই দুলাভাইকে দেখতে সুইফটিরা দেখবে খেলা। তবে যারা নিয়ম জানে না। তাদের পক্ষে এই খেলা বোঝা কঠিন । চিন্তা নেই, পড়তে থাকুন। আর সব বাঙালির মতোই আমিও একসময়ে ভাবতামÑ এইটা কি বাজে একটা খেলা, মারামারি ছাড়া আর কিছুই নেই। নাক সিঁটকে এক সময়ে আমেরিকান ফুটবল নিয়ে হাসাহাসি করেছি আর সারাবিশ্বের অন্যান্য সব খেলা এই খেলার চাইতে কতো ভালো তা নিয়ে সবার সাথে তাল মিলিয়েছি। কিন্তু ঘটনাচক্রে আমার কর্মক্ষেত্র আমেরিকার দক্ষিণে, যেখানে ফুটবল রীতিমতো একটা ধর্মের মতো। কারো সাথে দেখা হলে বাংলাদেশে যেমন জিজ্ঞাসা করা হয় আবাহনী না মোহামেডান, আর্জেন্টিনা না ব্রাজিল, এখানে সেরকমভাবে কোন দলের সমর্থক সেটা নিয়ে কথা উঠবেই।
এহেন এলাকায় এসে আমেরিকান ফুটবল যখন বোঝার চেষ্টা করছি তখন পুরো ব্যাপারটাকে একেবারেই সহজ বানিয়ে দিলো আমার ছেলে যায়ান। ৭-৮ বছর বয়সেই টিভি দেখে আর বন্ধুদের সাথে কথা বলে আমেরিকান ফুটবলের সবকিছু বুঝে ফেললো শুধু না, আমাকেও খুব সহজে বুঝিয়ে দিলো। যায়ান বাবার মতো শিক্ষকের কাছে এই খেলার নানা বিষয় শেখার পরে আমার চোখ খুলে গেলো। আমেরিকান ফুটবল আসলে চরম ইন্টারেস্টিং একটা খেলা। পুরো সময়টাতেই থাকে চরম উত্তেজনা। আর এটা মোটেও হেলমেট পরে মারামারির খেলা না। বরং এই খেলায় আছে বিশাল পরিমাণ হিসাব নিকাশের ব্যাপার, নানা স্ট্রাটেজি, আর খেলোয়াড়দের নৈপুণ্য। সাধে কি আর এই খেলা নিয়ে এখানে এতো উন্মাদনা? প্রবাসী বাংলাদেশীরা এখনো অনেকেই এই খেলাটা বুঝেন না, বা বুঝতেও চান না। অথচ ক্রিকেটের চাইতে আমেরিকান ফুটবল কম ইন্টারেস্টিং না। মূল বাধাটা হলো নিয়ম কানুন না বোঝা। সেটা না জানলে কিছুই আসলে বোঝা যাবে না। সবার তো আর যায়ান বাবার মতো শিক্ষক কাছে নাই, তাই আমি একটু চেষ্টা করি অল্প কথায় নিয়মকানুন ব্যাখ্যা করতে। এটা পড়ার পরে অন্তত খেলায় কী হচ্ছে তা বুঝতে পারবেন সহজেই।
[১] খেলার দল, মাঠ, ও সময়- খেলা হয় দুই দলে। প্রতি দলের হয়ে মাঠে ১১ জন করে থাকে। মাঠের দুই সাইডে দুইটা গোল পোস্ট থাকে কিন্তু সকারের মতো সেগুলার উপরে ক্রসবারের বাপার নাই বরং সেগুলা উপরে অনেক উঁচু পর্যন্ত থাকে। মাঠের সাইজ ১০০ গজ। প্রতি ১০ গজ পর পর দাগ দেয়া থাকে। বলটা গোল না বরং লম্বাটে টাইপের, দুই কোনা সুঁচালো। খেলাটা হয় হাতে হাতে। মানে বলটা হাতে ধরে দৌড়াতে পারে খেলোয়াড়েরা বা হাতে ছুড়ে দিতে পারে। কেবল ফিল্ড গোল অ্যাটেম্পট (নিচে বলা আছে) অথবা বল ফেরত দেয়ার সময়েই লাথি দেয়া যায়। খেলাটা হয় ৪টি কোয়ার্টার বা ১৫ মিনিটের অংশে। প্রথম দুই কোয়ার্টারের পরে হাফ টাইম থাকে। সকারের সাথে এই খেলার সময়ের পার্থক্য হলো আমেরিকান ফুটবলের ক্লক বা ঘড়ি পুরো সময় চালু থাকে না। শুধুমাত্র খেলা চলার সময়টাতে মানে যখন বলটা নিয়ে খেলা হচ্ছে তখন ঘড়ি চলে। কাজেই প্রতি কোয়ার্টার ১৫ মিনিটের হলেও এক কোয়ার্টার শেষ হতে লাগতে পারে এর দ্বিগুণ সময়।
[২] খেলার মূল লক্ষ্য কী? লক্ষ্য হলো বলটাকে প্রতিপক্ষের শেষ সীমা পার করে দেয়া। এইটা করতে পারলে তাকে বলে টাচডাউন। আর পাওয়া যায় ৬ পয়েন্ট। আর ফিল্ড গোল নামের একটা সুযোগ আছে। অনেকটা সকারের ফ্রি কিকের মতো। বলটাকে লাথি দিয়ে গোলপোস্টের দুই বারের মাঝে দিয়ে (যত উপরেই হোক না কেনো) পাঠাতে পারলে ফিল্ড গোল হবে। টাচডাউন করলে ফিল্ড গোলের চান্স মিলে একটা, সেটাতে আছে ১ পয়েন্ট। আর টাচডাউন বাদে ফিল্ড গোল হলে সেটা ৩ পয়েন্ট। যে দল যত বেশি পয়েন্ট পাবে খেলা শেষে তারাই জিতবে।
[৩] খেলার ধাপ : অন্যান্য অনেক খেলা যেমন সকারের মতো এটা নিরবিচ্ছিন্ন খেলা না। পুরো খেলাটা হয় ধাপে ধাপে। প্রতিটা ধাপকে বলা হয় ংপৎরসসধমব বা ফড়হি। একটা দল তার নিজের সীমায় ২৫ গজ লাইন থেকে শুরু করে। প্রতিটা ডাউনের উদ্দেশ্য হলো বলটাকে ১০ গজ সামনে আগানো। খেলার সময়ে দুইটা লাইন দেখবেন টিভিতে। একটা হলো লাইন অফ স্ক্রিমেজ, যেখানে খেলোয়াড়েরা বলটা নিয়ে দাঁড়াবে। আর তার ১০ গজ সামনে থাকবে তাদের লক্ষ্য। খেলার মূল স্টার হলো কোয়ার্টারব্যাক পজিশনের খেলোয়াড়। স্ক্রিমেজের সময়ে স্ক্রিমেজ লাইনে দাঁড়ানো খেলোয়াড়দের মধ্যে সেন্টার পজিশনের খেলোয়াড় বলটা পিছনে দাঁড়ানো কোয়ার্টারব্যাকের কাছে ছুড়ে দিবে। কোয়ার্টারব্যাকের কাজ হলো হয় বলটা ধরে সামনের দিকে কোনো প্লেয়ারের কাছে পাস দেয়া। অথবা নিজেই বলটা নিয়ে দৌড় দেয়া। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা বলটা সামনে আগানো বন্ধ করার চেষ্টা করবে বল যার কাছে আছে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার মাধ্যমে। কোয়ার্টারব্যাক একবারই পাস দিতে পারবে। সেই বলটা যার কাছে যাবে সে কিন্তু কাউকে পাস দিতে পারবে না। বলটাকে নিয়ে যদি ১০ গজ সামনের সেই লাইন পার হওয়া সম্ভব হয় তাহলে যেখানে প্রতিপক্ষের ধাক্কা খেয়ে প্লেয়ার থামবে।
সেখান থেকে আবার ফার্স্ট ডাউনের সুযোগ আসবে। আর যদি ১০ গজ আগানো সম্ভব না হয় তাহলে যেখানে থেমেছে সেখান থেকে সেকেন্ড ডাউন হবে। ধরা যাক ৩ গজ সামনে এগিয়েছে, সেটাকে বলা হবে সেকেন্ড অ্যান্ড ৭। এভাবে ৪ বার স্ক্রিমেজের সুযোগ আছে। আগানোর বদলে পিছানোও হতে পারে কিন্তু। ধরা যাক ৩ গজ পিছিয়ে গেছে। তখন হবে সেকেন্ড ডাউন, যা সেকেন্ড অ্যান্ড ১৩ বলা হবে। চারবার স্ক্রিমেজের সুযোগ থাকলেও সাধারণত ৩ বারে ১০ গজ আগাতে না পারলে বলটাকে কিক করে প্রতিপক্ষের কাছে দিয়ে দেওয়া হয় যাতে তারা তাদের দিক থেকে শুরু করতে পারে। এটাকে বলা হয় পান্ট। চাইলে চতুর্থবারে চেষ্টা করা যায় বটে, কিন্তু সেখানে সফল না হলে প্রতিপক্ষ ঠিক এই জায়গা থেকেই বলটা পাবে। তাই সাধারণত ফোর্থ ডাউনে চেষ্টা না করে পান্ট করে বলটা প্রতিপক্ষকে দেওয়া হয়। তবে যদি কোচ মনে করেন যে ফোর্থ ডাউনে বলটা আগানো যাবে তাহলে অনেক সময় মরীয়া হয়ে আগানোর চেষ্টা করা যায় বটে। আর আরেকটা উপায় হলো, প্রথম ৩ ডাউনে আগাতে না পারলেও যদি প্রতিপক্ষের গোলের অনেকটা কাছে আসা যায় তাহলে ফিল্ড গোল অ্যাটেম্পট নেয়া। এভাবে ফিল্ড গোল করলে ৩ পয়েন্ট মিলে।
[৪] খেলোয়াড় সংখ্যা- আমেরিকান ফুটবলের আরেকটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো এই খেলায় প্রতি টিমের ডিফেন্স আর অফেন্স টিম পুরা আলাদা থাকে। মানে যখন কোনো দলের হাতে বল থাকে, তাদের ১১ জন প্লেয়ার হলো অফেন্সের প্লেয়ার। যেই মাত্র বল হাতছাড়া হবে তখন এই ১১ জন মাঠ ছেড়ে নেমে যাবে। তাদের বদলে আসবে ডিফেন্সের ১১ জন প্লেয়ার। আর প্রতিপক্ষের ডিফেন্সের বদলে আসবে অফেন্সের প্লেয়ারেরা। একেকটা দলে অফেন্স ডিফেন্স মিলিয়ে মোট ১০০ জনের মতো প্লেয়ার থাকে। যেকোনো সময়ে যেকোনো প্লেয়ার পরিবর্তন করা যায়।
[৫] পেনাল্টি/ফাউল এর সিস্টেম- এবারে আসি এই খেলার ধাক্কাধাক্কি নিয়ে। বাংলাদেশিদের কাছে ধাক্কাধাক্কি মনে হয় কারণ সকারের মতো ছোঁয়া লাগলেই ফাউল এমন সিস্টেম এখানে নাই। বরং ধাক্কা দিয়ে প্রতিপক্ষের বলধারী প্লেয়ারকে ফেলে দেয়াটাই খেলার অংশ। খেলোয়াড়েরা এজন্য হেলমেট আর প্যাড পরে খেলে। তবে এর মানে এই না যে ইচ্ছামতো মারামারি। বল নাই এমন কাউকে ধাক্কা দেয়া যাবে না। ধাক্কার সময়ে হেলমেট ধরে টান দেয়া যাবে না। আর কেউ আহত হতে পারে এমন ধাক্কা দেয়া নিষিদ্ধ। খেলার আম্পায়ারেরা সারাক্ষণ নিয়ম ভঙ্গ হচ্ছ কি না সেটা দেখেন। নিয়ম ভাঙলে ভষধম ছুড়ে দেয়া হয় আর খেলা থামিয়ে পেনাল্টি নির্ধারণ করা হয়। অফেন্সের পেনাল্টি হলো তাদের ৫ বা ১০ গজ পিছিয়ে যেতে হয়। আর ডিফেন্স ফাউল করলে অফেন্সকে অটোম্যাটিক ফার্স্ট ডাউন দেয়া হয় ফাউলের জায়গা থেকে। মোটের উপরে এই হলো আমেরিকান ফুটবলের একেবারে প্রাথমিক কিছু নিয়মকানুন।
আমেরিকার কলেজ ফুটবলের কথা শুরুতে বলেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা লীগ বা কনফারেন্সের সদস্য হয়। ১০-১২টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একেকটি কনফারেন্স হয়। আর সিজন শেষে নানা কনফারেন্সের চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে হয় শুরু হয় জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অষধনধসধ, এবড়ৎমরধ, ঈষবসংড়হ, ঙযরড় ঝঃধঃব, গরপযরমধহ এরা সব প্রচণ্ড শক্তিশালী আর জনপ্রিয় টিম। আর ফুটবল টিমের কোচেরা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের চাইতেও অনেক গুণ বেশি বেতন পান। যেমন আলাবামার বিখ্যাত কোচ নিক শাবানের বার্ষিক বেতন হলো ১১.৭ মিলিয়ন ডলার (মানে মাসে প্রায় ১ মিলিয়ন করে বেতন)। আর আলাবামার প্রেসিডেন্ট পুরো বছরে পান ৭ লাখ ডলার। একটা হিসাবে দেখা গেছে, আমেরিকার অধিকাংশ রাজ্যেই ফুটবল বা বাস্কেটবল কোচেরা হলেন সেখানকার সর্বোচ্চ বেতনপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী। এর অবশ্য কারণও আছে। বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই শিক্ষার্থীরা সেখানকার কলেজ ফুটবল টিমের ব্যাপারটা মাথায় রাখে। আর একেকটা খেলার দিন হাজার থেকে শুরু করে লাখ খানেক দর্শকও হয়।
ইউনিভার্সিটি অফ আলাবামার ফুটবল স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা ১ লাখের মতো। খেলার দিনে সেটা পুরাই ভর্তি থাকে। আর পুরা স্টেটের অর্ধেকের বেশি লোকজন আলাবামার সাপোর্টার (বাকিরা তাদের প্রতিপক্ষ অবার্ন এর)। খেলার দিনে রাস্তাঘাট খালি হয়ে যায় আর সবাই নিজের টিমের পোষাক পরে। টিম স্পিরিট বলে কথা। আশা করি সংক্ষেপে আমেরিকান ফুটবলের নিয়মটা বোঝাতে পারলাম কিছুটা। আরও অনেক নিয়ম আছে যা সময় ও স্থানাভাবে এখানে বলতে পারলাম না। তবে এই নিয়মগুলো জানলে কলেজ ফুটবল বা প্রফেশনাল ফুটবল খেলা কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন। আর বুঝতে পারবেন, এটা মোটেও মারামারির খেলা না, বরং চরম উত্তেজনাময় একটা খেলা যা উপভোগ করার মতো বটে। লেখক: শিক্ষক ও গবেষক। ফেসবুক থেকে